ABO রক্ত গ্রুপ।Rh ফ্যাক্টর

ABO রক্ত গ্রুপ ও Rh ফ্যাক্টরের কারণে সৃষ্ট সমস্যা

ABO রক্ত গ্রুপ- অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথম থেকেই ফ্রান্সে এবং পরে ইংল্যান্ডে মানুষ থেকে মানুষে রক্তদান প্রক্রিয়া শুরু হয়। এ প্রক্রিয়ায় অনেক ক্ষেত্রে দাতা ও গ্রহীতার রক্তের মধ্যে কোনরূপ বিরূপ প্রতিক্রিয়া না হলেও কোন কোন ক্ষেত্রে মারাত্মক বিরূপ প্রতিক্রিয়ার ফলে গ্রহীতা অল্প সময়ের মধ্যেই মৃত্যুমুখে পতিত হতাে মানবদেহের বাইরে দাতা ও গ্রহিতার রক্ত মিশ্রিত করে দেখা গেছে যে, কোন কোন ক্ষেত্রে উভয়ের রক্ত স্বাভাবিক ভাবে না মিশে কণিকাগুলাে পরস্পর জড়িয়ে (coagulate) যায়। আবার কোন কোন ক্ষেত্রে দাতা গ্রহিতা উভয়ের রক্ত স্বাভাবিকভাবে মিশে যায়।

অস্ট্রিয়ার বিজ্ঞানী প্যাথােলজিস্ট ড. কার্ল ল্যান্ডস্টেইনার (১৯০০ খ্রিস্টাব্দে) এর গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে, মানুষের রক্তের লােহিত কণিকার প্লাজমা মেমব্রেনের বাইরের দিকে দুই প্রকারের অ্যাগ্লুটিনােজেন (agglutinogen) পাওয়া যায় । এদের অ্যাগ্লুটিনােজেন বা অ্যান্টিজেন A এবং অ্যাগ্লুটিনােজেন বা অ্যান্টিজেন B বলে। একই সাথে প্লাজমায়(রক্ত রসে দুই প্রকারের অ্যাগ্লুটিনিন (agglutinin) পাওয়া যায়।

এদেরকে অ্যাগুটিনিন বা অ্যান্টিবডি a এবং অ্যাগ্লুটিনিন বা অ্যান্টিবডি b বলে। প্রতিটি অ্যান্টিবডি শুধু নির্দিষ্ট এন্টিজেনের সাথে বিক্রিয়া ঘটাতে সক্ষম। অর্থাৎ অ্যান্টিবডি a শুধু অ্যান্টিজেন A এর সাথে এবং অ্যান্টিবডি b শুধু অ্যান্টিজেন B এর সাথে বিরূপ প্রতিক্রিয়া ঘটাতে সক্ষম।

রক্তে এই অ্যান্টিজেন ও অ্যান্টিবডির উপস্থিতি বা অনুপস্থিতির উপর ভিত্তি করে মানুষের রক্তকে ৪টি গ্রুপে ভাগ করা যায়।এ ধরনের রক্ত গ্রুপ ABO রক্ত গ্রুপ নামে পরিচিত।

লােহিত রক্তকণিকায় অ্যান্টিজেন A থাকলে রক্তকে A গ্রুপ, অ্যান্টিজেন B থাকলে B গ্রুপ, অ্যান্টিজেন A ও B উভয়ে উপস্থিত থাকলে AB গ্রুপের প্লাজমায় উক্ত গ্রুপের রক্তকণিকা অ্যাগ্লুটিনেট (agglutinate = জট পাকিয়ে দেয়) করার জন্য কোন অ্যান্টিবডি নেই অর্থাৎ অ্যান্টিবডি a নেই; তবে অ্যান্টিবডি b থাকে যা B গ্রুপের কণিকাগুলােকে অ্যাগ্লুটিনেট করে দেয়।

অনুরূপভাবে B গ্রুপের প্লাজমায় উক্ত গ্রুপের কণিকাকে অ্যাগ্লুটিনেট করতে সক্ষম অ্যান্টিবডি b নেই তবে অ্যান্টিবডি a আছে যা A গ্রুপের কণিকাগুলােকে অ্যাগ্লুটিনেট করে দেয়। ক্রোমােসােমের একই লােকাসে অবস্থিত তিনটি অ্যালিলিক জিন দ্বারা মানুষের রক্তগ্রুপ নিয়ন্ত্রিত। পরস্পর অ্যালিল এই জিনগুলাে যেকোনাে দুইটি একই সময়ে এক জন মানুষে একজোড়া হােমােলােগাস ক্রোমােসােমের একই লােকাসে উপস্থিত থাকতে পারে। জিনত্রয়কে LA, LB এবং LO  সংকেত (symbol) দ্বারা প্রকাশ করা হয়ে থাকে।

এদের মধ্যে LA ও LB কোডমিন্যান্ট ও LO  জিনটি LA ও LB জিনের প্রচ্ছন্ন অ্যালিল হিসেবে আচরণ করে। তবে LA ও LB জিন দুইটি একই সময়ে উপস্থিত থাকলে উভয়ের বৈশিষ্ট্য সমভাবে প্রকাশ পায় অর্থাৎ একটি অন্যটির উপর প্রকট নয়-কোডমিন্যান্ট(codominant)।

রেসাস রক্ত গ্রুপ বা Rh রক্ত গ্রুপ (Rh or Rhesus Blood Group)

রেসাস বানরের রক্ত নিয়ে গবেষণাকালে ল্যান্ডস্টেইনার এবং এম.এম ওয়াইনার ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে একটি অ্যান্টিজেন আবিষ্কার করেন এবং রেসাস বানরের(Macaca mulatta) নামানুসারে এই অ্যান্টিজেনকে রেসাস অ্যান্টিজেন বা ফ্যাক্টর বা সংক্ষেপে Rh ফ্যাক্টর নামে অভিহিত করেন।

রেসাস বানরের রক্ত গিনিপিগের দেহে প্রবেশ করালে Rh এন্টিজেনের প্রভাবে যে অ্যান্টিবডি উৎপন্ন হয় তা যে কোন রেসাস বানরের রক্তের লােহিত কণিকাগুলােকে জট বাধিয়ে দেয়। এই অ্যান্টিবডি সমৃদ্ধ গিনিপিগের সেরামের সাথে মানুষের লােহিত কণিকা মিশ্রিত করলে কোন কোন ব্যক্তির কণিকাগুলাে জট বেঁধে যায়। এতে প্রমাণিত হয় যে, কোন কোন মানুষের লােহিত কণিকায় রেসাস বানরের অনুরূপ Rh অ্যান্টিজেন বর্তমান।

Rh এন্টিজেনের উপস্থিতি বা অনুপস্থিতি বিবেচনা করে মানুষকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে, যথাক্রমে Rh পজিটিভ(Rh+) ও (Rh) নেগেটিভ (Rh)। Rh ফ্যাক্টরের কারণে সৃষ্ট সমস্যা

১। রক্ত সঞ্চালনের জটিলতা

কোন মানুষের দেহে স্বাভাবিক ভাবে Rh অ্যান্টিবডি থাকে না, তবে একজন Rh পজিটিভ ব্যক্তির রক্ত কোন কারণে Rh নিগেটিভ মানুষের দেহে প্রবেশ করলে এই অ্যান্টিবডি উৎপন্ন হয়। দাতা ও গ্রহিতার মধ্যে আদান-প্রদানের ক্ষেত্রে এই অ্যান্টিজেন-অ্যান্টিবডির ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

উদাহরণস্বরূপ, সড়ক দূর্ঘটনায় আহত অবস্থায় একজন Rh নেগেটিভ ব্যক্তিকে সামঞ্জস্যপূর্ণ ABO গ্রুপের Rh পজিটিভ ব্যক্তির রক্ত প্রদান করা হলাে। যদি আহত ব্যক্তি ইতিপূর্বে আর কোনদিন Rh পজিটিভ রক্ত গ্রহণ না করে থাকে তাহলে ভয়ের কারণ নেই।

কেননা, তার দেহে Rh অ্যান্টিবডি অনুপস্থিত। কিন্তু যদি ঐ ব্যক্তিকে পরবর্তীকালে পুনরায় Rh পজিটিভ দাতার রক্ত গ্রহণ করতে হয় তাহলে তার দেহে দাতার রক্ত কণিকাগুলাে জট বেঁধে যাবে। কারণ, প্রথম বার রক্ত গ্রহণের ফলে গ্রহীতার দেহে Rh অ্যান্টিবডি উৎপন্ন হয়েছিল।

ফলে রক্ত গ্রহীতার মৃত্যু ঘটতে পারে। এরূপ মারাত্মক পরিণতি এড়াবার জন্য সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে কোন Rh নেগেটিভ ব্যক্তি Rh পজিটিভ দাতার রক্ত প্রদান করা উচিত নয়।

২। গর্ভধারণজনিত জটিলতা/এরিথ্রোব্লাস্টোসিস ফিটালিস

শিশু জন্মের ক্ষেত্রে Rh ফ্যাক্টর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জীবনে কোনােদিন Rh+ রক্ত গ্রহণ না করলেও একজন Rh মহিলা যদি Rh+ পুরুষকে বিয়ে করে এবং Rh+ সন্তান গর্ভে ধারণ করে তবে ঐ মহিলার দেহে Rh অ্যান্টিবডি উৎপন্ন হতে পারে।

তবে প্রথম বার গর্ভধারণ কালে Rh অ্যান্টিবডি যথেষ্ট পরিমাণে উৎপাদিত না হওয়ায় শিশুর কোন ক্ষতি করতে পারে না। কিন্তু পরবর্তী Rh+ সন্তান ধারণকালে ইতিপূর্বে মায়ের প্লাজমায় উৎপাদিত Rh অ্যান্টিবডি প্লাসেন্টার মাধ্যমে ভ্রূণের দেহে প্রবেশ করে লােহিত কণিকাগুলােকে নষ্ট করে দেয় যার প্রকোপ সাধারণ গর্ভাবস্থায় শেষ পর্যায়ে অধিক।

লােহিত কণিকার ভাঙ্গন বা হিমােলাইসিসজনিত এ রক্তাল্পতার রােগকে এরিথ্রোব্লাস্টোসিস ফিটালিস নামে অভিহিত করা হয়। এর ফলে ধ্বংসপ্রাপ্ত কণিকাগুলাে যার যকৃতের রক্তবাহিকা অবরুদ্ধ হয়ে যায় এবং রক্তে প্রচুর পরিমাণে পিত্ত প্রবেশ করে জন্ডিস অবস্থার সৃষ্টি করে।

একজন Rh মহিলা প্রথমবার গর্ভধারণের পূর্বে Rh+ রক্ত গ্রহণ করে থাকলে এবং Rh’ সন্তান গর্ভে ধারণ করলে প্রথম সন্তান সমভাবে এরিথ্রোব্লাস্টোসিস ফিটালিস রােগে আক্রান্ত হতে পারে।

Leave a Comment