হৃদপিণ্ড ও এর বাহ্যিক গঠন

হৃদপিণ্ড

পেশিবহুল ত্রিকোণাকার, ফাঁপা, চার প্রকোষ্ঠযুক্ত পাম্পের মতাে যন্ত্র যার সংকোচন ও প্রসারণের ফলে সারা দেহে রক্ত সঞ্চালিত হয় তাকে হৃদপিণ্ড বলে। রক্তকে রক্তবাহিকার ভেতর দিয়ে সঞ্চালনের জন্য হৃদপিণ্ড মানবদেহের পাম্প যন্ত্ররূপে কাজ করে।

মানব হৃদপিন্ডের ওজন

একটি হৃদপিণ্ডের ওজন প্রায় ৩০০ গ্রাম, তবে স্ত্রীলােকের ক্ষেত্রে তা পুরুষের তুলনায় ১/৩ অংশ কম হয়।

হৃদপিন্ডের অবস্থান

মানুষের হৃদপিণ্ড বক্ষ গহ্বরের মধ্যচ্ছদার উপরে ও দুই ফুসফুসের মাঝ বরাবর অঞ্চলে বাম দিক ঘেঁষে তির্যকভাবে অবস্থিত।এর সম্মুখভাব স্টার্নামের দিকে পচাঙ্গ মেরুদন্ত্রে দিকে এবং নিম্নভাগ ডায়াফ্রামের উপরে থাকে। হৃদপিণ্ডটি ডান দিকের দ্বিতীয় কশেরুকা থেকে বাম দিকের পঞ্চম কশেরুকা পর্যন্ত তির্যকভাবে অবস্থান করে।

হৃদপিন্ডের রং

এটি দেখতে লালচে রংয়ের।

আকার আকৃতি

হৃদপিণ্ড মাংসল, ফাঁপা মােচার মতাে ও ত্রিকোণাকার। এর দৈর্ঘ্য ১২-১৩ সে.মি., প্রস্থ ৯-১০ সে.মি. এবং ৬ সে.মি. পুরু।

বাহ্যিক গঠন

হৃদপিন্ডের চওড়াঃ উর্ধ্বমুখী অংশকে “বেস” (Base) এবং ক্রমশ সরু নিম্নমুখী অংশকে এপেক্স (Apex) বলে।হৃদপিণ্ডে প্রশস্ত সম্মুখভাগ অলিন্দ দ্বারা ও পশ্চাতের মােচাকার অংশটি নিলয় দ্বারা গঠিত।

আবরন

হৃদপিণ্ড একটি দ্বিস্তরী পেরিকার্ডিয়াম নামক পাতলা ঝিল্লিতে আবৃত। এর বাইরের স্তরটিকে প্যারাইটাল ও ভেতরেরটিকে ভিসেরাল বলে। স্তর দুটির মাঝে তরল পদার্থপূর্ণ পেরিকার্ডিয়াম গহ্বার থাকে যা হৃদপিণ্ডের সংকোচন ও নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।

পেরিকার্ডিয়াম হৃদপিণ্ডকে বাইরের আঘাত থেকে রক্ষা করে। হৃদপিণ্ডের স্পন্দন নিয়ন্ত্রণ করে। হৃদপিণ্ডকে সর্বদা সিক্ত রেখে শুষ্কতার হাত থেকে রক্ষা করে।

হৃদপিণ্ডের প্রাচীর

হৃদপিণ্ডের প্রাচীর অনৈচ্ছিক পেশি দিয়ে গঠিত। এসব পেশিকে হৃদপেশী বা কার্ডিয়াক পেশি (Cardiac muscle) বলে। পেশিগুলাে তিন স্তরবিশিষ্ট, যেমন-

ক. এপিকার্ডিয়াম (Epicardium)

এটি হৃদপ্রাচীরের সবচেয়ে বাইরের স্তর এবং যােজক কলায় তৈরি। এই স্তরে বিক্ষিপ্তভাবে চর্বি লেগে থাকে।

খ.মায়ােকার্ডিয়াম (Myocardium)

এটি হৃদপ্রাচীরে মধ্যবর্তী স্তর। স্তরটি পুরু, দৃঢ় প্রকৃতির এবং এগুলাে হৃদপিণ্ডের সংকোচন প্রসারণে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে।

গ. এন্ডোকার্ডিয়াম (Endocardium)

এটি হৃদপ্রাচীরের ভেতরের স্তর যা হৃদপিণ্ডের প্রকোষ্ঠের অন্তঃপ্রাচীর গঠন করে, হৃদপিন্ডের কপাটিকাসমূহ ঢেকে রাখে এবং রক্তের সাথে হৃদপিণ্ডের অবিচ্ছিন্ন সংযােগ ঘটায়।

হৃদপিণ্ডের প্রকোষ্ঠ সমূহ

মানুষের হৃদপিণ্ড চারটি প্রকোষ্ঠে বিভক্ত। যথা- ডান অলিন্দ ও বাম অলিন্দ এবং ডান নিলয় ও বাম নিলয়।

অলিন্দ (Auricle)

প্রশস্ত পাতলা প্রাচীরবিশিষ্ট প্রকোষ্ঠ। আন্তঃঅলিন্দ বিভেদক প্রাচীর দ্বারা ডান ও বাম প্রকোষ্ঠে বিভক্ত। ডান অলিন্দ বাম অলিন্দ অপেক্ষা সামান্য বড়। বাম ও ডান উভয় দিক থেকে দুটি করে পালমােনারী শিরা বাম অলিন্দে প্রবেশ করে একটি বড় অলিন্দ নিলয় ছিদ্র পথে বাম নিলয়ে উন্মুক্ত হয়। ডান অলিন্দে সুপিরিয়র ভেনাক্যাভা, ইউস্টেশিয়ান কপাটিকা যুক্ত ইনফিরিয়র ভেনাক্যাভা এবং থেবেশিয়ান কপাটিকাযুক্ত করােনারী সাইনাস নিজ নিজ ছিদ্র পথে উন্মুক্ত হয়। ডান অলিন্দ নিলয় ছিদ্র পথে ডান নিলয়ে উন্মুক্ত হয়।

নিলয় (Ventricle)

নিলয় অলিন্দের নিম্ন ভাগে অবস্থিত। আন্তঃনিলয় পর্দা দ্বারা ডান ও বাম প্রকোষ্ঠে বিভক্ত। নিলয়ের প্রাচীর অলিন্দের প্রাচীর অপেক্ষা বেশ পুরু। বাম নিলয়ের প্রাচীর ডান নিলয়ের প্রাচীর অপেক্ষা প্রায় তিনগুন পুরু। কারণ ডান নিলয় কেবলমাত্র ফুসফুসে রক্ত সঞ্চালিত করে কিন্তু বাম নিলয়ের সংকোচনে সারাদেহে রক্ত সঞ্চালিত হয়।

কপাটিকাসমূহ

অলিন্দ ও নিলয়ের মাঝে যে ছিদ্র থাকে তাকে অলিন্দ নিলয় ছিদ্র বলে। বাম অলিন্দ ও নিলয়ের মুখে বাইকাসপিড কপাটিকা (Bicuspid valve) বা ভাল ও ডান অলিন্দ নিলয়ের ছিদ্রের মুখে ট্রাইকাসপিড কপাটিকা (Tricuspid valve)থাকে।

অলিন্দ নিলয় ছিদ্রপথ এই কপাটিকা দ্বারা খােলা বন্ধ নিয়ন্ত্রিত হয়। এই উভয় ধরনের কপাটিকা নিলয় প্রাচীরের মাংসল অভিক্ষেপ প্যাপিলারি পেশির (Papillary muscle) সাথে কর্ডিটেন্ডিনি (Cordae tendinae) নামক তন্তু দিয়ে যুক্ত থাকে।

ডান নিলয় থেকে উদ্ভুত পালমােনারি ধমনির ছিদ্রপথে এবং বাঁ নিলয় থেকে উদ্ভূত অ্যাওর্টার মুখে দুটি করে সেমিলুনার কপাটিকা (Semilunar valve) থাকে। এরা রক্তকে নিয়ে ফিরে আসতে বাধা দেয়। অলিন্দে সুপিরিয়র ভেনাক্যাভা এবং পালমােনারি শিরার মিলিত স্থানে কোন কপাটিকা থাকে না।

Leave a Comment