সহজাত আচরণের প্রকারভেদ।প্রতিবর্তি ক্রিয়া (Reflex action)

সহজাত আচরণ

একটি প্রজাতির অন্তর্ভুক্ত প্রতিটি প্রাণী কোন রকম শিক্ষা বা পূর্ব অভিজ্ঞতা ছাড়াই জৈবিক প্রয়ােজন মেটাতে বা আত্মরক্ষার তাগিদে বংশ পরম্পরায় একইভাবে যেসব জন্মগত অপরিবর্তনীয় আচরণ প্রদর্শন করে তাকে সহজাত আচরণ বলে।

সহজাত আচরণের প্রকারভেদ

প্রাণীকূলের মাঝে বিভিন্ন রকমের সহজাত আচরণ পরিলক্ষিত হয়, যা নিম্নে উল্লেখ করা হলাে-

১। বিগ্রহ আচরণ

বিভিন্ন প্রজাতির মাঝে প্রজনন ঋতুতে জনন ক্ষেত্র নির্বাচনের সময় বিগ্রহ সৃষ্টি হতে দেখা যায়। গায়ক পাখি, তিন কাঁটা স্টিকল ব্যাক, এন্টিলােপ প্রভৃতি প্রাণীর প্রসঙ্গ এখানে উল্লেখ করা যায়।

২। যুগলবন্দী ও মৈথুন আচরণ

এরূপ আচরণে যৌন মিলনের প্রথম পর্বে স্ত্রী ও পুরুষ পরস্পরকে আকর্ষণ করে। বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণী বিভিন্ন ভাবে তাদের সঙ্গীদের আকর্ষণ করার চেষ্টা করে। অনেক পুরুষ পাখি স্ত্রী পাখিকে আকৃষ্ট করার জন্য মৈথুন ডাক এর আশ্রয় নেয়। বসন্তকালে কোকিলের কুহু ডাক, রাতের বেলায় ঝিঁঝি পােকার ডাক ইত্যাদি দূরবর্তী সঙ্গীকে আকর্ষণ করার ফন্দি।

৩। বাৎসল্য আচরণ

সন্তান জন্মানাের আগে বা পরে বাচ্চার যত্ন বা লালন পালনের জন্য পিতা বা মাতা কিংবা উভয়ই যে আচরণ প্রদর্শন করে সেটাই বাৎসল্য আচরণ। মাছ, উভচর, সরীসৃপ, পাখি ও স্তন্যপায়ী ভিন্ন ভিন্ন ভাবে এই আচরণ প্রদর্শণ করে।

যেমন- অধিকাংশ পাখির ক্ষেত্রে বাৎসল্য আচরণকে নিম্নলিখিত তিনটি পর্যায়ে ভাগ করা যায়ঃ

ক) বাসা তৈরি,

খ) ডিমে তা দেওয়া,

গ) ছানার প্রতি যত্নবান হওয়া।

৪। অভিপ্রয়ান আচরণ

মাছ এবং পাখির ক্ষেত্রে অভিপ্রয়ান স্বভাব অতি স্পষ্ট ভাবে লক্ষ করা যায়। যেমন- ইলিশ মাছ ডিম ছাড়ার জন্য সমুদ্র হতে বহু দূর পথ অতিক্রম করে নদীর স্বাদু পানিতে অভিপ্রয়ান ঘটায়। আবার বিভিন্ন প্রজাতির পাখি সাইবেরিয়া অঞ্চল থেকে শীতকালে বাংলাদেশে অভিপ্রয়ান করে এবং শীতের শেষে সাইবেরিয়াতে ফিরে যায় ।

৫। খাদ্য অন্বেষণ আচরণ

পাখি ও স্তন্যপায়ী প্রাণীতে এ ধরনের আচরণ বেশী দেখা যায়। কোন একটি প্রাণী সব ধরনের খাদ্য খায় না বরং খাওয়ার ব্যাপারে প্রতিটি প্রাণীর একটি নির্দিষ্ট পছন্দ থাকে। বিজ্ঞানীরা প্রত্যক্ষ করেছেন। একই পরিবেশে বসবাস করা সত্ত্বেও ঘনিষ্ঠ সম্পর্কযুক্ত অনেক প্রজাতির খাদ্য ভিন্ন প্রকৃতির হতে পারে।

৬। পলায়ন প্রবৃত্তি

শিকারী প্রাণীর হাত থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য অনেক জীবের মধ্যে পলায়ন প্রবৃত্তি দেখা যায়। যেমন বাজপাখিকে দেখামাত্র কাঠঠোকরা পাখি গাছের মধ্যে আত্মগােপন করে এবং বাজপাখি সরে না যাওয়া পর্যন্ত নিশ্চুপ অবস্থায় থাকে। আবার কিছু কিছু প্রাণী (যেমন- অক্টোপাস) বর্ণের পরিবর্তন ঘটিয়ে শত্রুর হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার চেষ্টা করে।

৭। নিদ্রামগ্ন আচরণ

প্রতিকূল আবহাওয়ার হাত থেকে বাঁচার তাগিদে কোন কোন প্রাণী নিষ্ক্রিয় অবস্থার ভেতর দিয়ে কিছু সময় অতিবাহিত করে। যেমন অত্যধিক শীত হতে বাঁচার জন্য ব্যাঙ শীতনিদ্রায় গমন করে।

৮। সঞ্চয় স্বভাব

অনেক প্রাণী বিশেষ করে কীট পতঙ্গ (পিঁপড়া, মৌমাছি ইত্যাদি) ও ইঁদুর তাদের আবাসস্থলের সীমানায় বা অন্য কোন নিরাপদ স্থানে খাদ্য মজুত করে রাখে।

সহজাত আচরণের উদাহরণঃ ট্যাক্সিস, প্রতিবর্তি ক্রিয়া, স্বভাবজাত আচরণ

প্রতিবর্তি ক্রিয়া (Reflex action)

কোন আকস্মিক উদ্দীপনায় এক বিশেষ ধরনের স্বয়ংক্রিয় ও অনৈচ্ছিক আচরণকে প্রতিবর্তি ক্রিয়া বলে।

জীবনের অবস্থার সাথে মােকাবেলা করার জন্য প্রাণী বিচার বিবেচনা না করে বহিঃউদ্দীপকের ক্রিয়ার ফলে স্বতঃস্ফূর্তভাবে এ ধরনের প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। এ ধরনের ক্রিয়া মস্তিষ্ক দ্বারা নিয়ন্ত্রিত না হয়ে স্নায়ুতন্ত্রের সুষুম্নাকাণ্ড (Spinal cord) দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়।

যেমন- গরম কিছু হাতে লাগলে সঙ্গে সঙ্গে হাত সরে আসা, চোখে কিছু পড়লে আপনা থেকেই চোখ বন্ধ হয়ে যাওয়া,পায়ে কাঁটা ফুটলে অতি ক্ষিপ্রতার সাথে পা সরিয়ে নেয়া ইত্যাদি।

প্রতিবর্তি ক্রিয়ার বৈশিষ্ট্য

১) এটি সম্পূর্ণ অনৈচ্ছিক ধরনের প্রতিক্রিয়া, এর পেছনে কোন পূর্ব পরিবল্পনা থাকে না।

২) এটি সহজে সংশােধিত বা পরিবর্তিত হয় না;

৩) এক ধরনের উদ্দীপক এক ধরনের প্রতিক্রিয়াই সৃষ্টি করে।

৪) প্রতিবর্তি ক্রিয়া সহজাত বা জন্মগত, শিক্ষালব্ধ নয়। এটি সহজ প্রকৃতির।

৫) প্রতিবর্তি ক্রিয়া খুব দ্রুতগতিতে সম্পন্ন হয়; সংবেদনের সাথে সাথেই দৈহিক ক্রিয়া সম্পন্ন হয়।

প্রতিবর্তি ক্রিয়ার কৌশল

গরম জিনিস হঠাৎ আঙ্গুলে লাগামাত্র আমরা হাত সরিয়ে নেই। কারণ- গরম জিনিস আঙ্গুলে লাগামাত্র সেখানকার ত্বকে অবস্থিত সংবেদী স্নায়ুর ডেনড্রাইট জ্বালা যন্ত্রণার উদ্দীপনা গ্রহণ করে। এখানে আঙ্গুলের ত্বক সংগ্রাহক অঙ্গের কাজ করে। আঙ্গুলের ত্বক থেকে উদ্দীপনা সংবেদী স্নায়ুর মাধ্যমে মেরুরজ্জ্বর গ্রে-ম্যাটার অবস্থিত সংবেদী স্নায়ুর অ্যাক্সন ও সংযােজক স্নায়ুর ডেনড্রাইটের মধ্যবর্তী সিন্যাপস এর মধ্য দিয়ে তড়িৎ রাসায়নিক শক্তিরূপে কর্মোদ্দীপনা মোটর স্নায়ুতে প্রবেশ করে এবং এর অ্যাক্সন কর্তৃক পরিবর্তিত হয়ে আঙ্গুলের পেশিতে পৌছায়। ফলে স্বতঃস্ফূর্তভাবে পেশি সংকুচিত হয় এবং সম্পূর্ণ অনৈচ্ছিকভাবে হাত সয়ে যায়।

প্রতিবর্তি ক্রিয়া সংঘটন প্রক্রিয়া

যে পথে প্রতিবর্তি ক্রিয়া সংঘটিত হয় তাকে প্রতিবর্তি চক্র বলে। প্রতিবর্তি চক্রের নিম্নলিখিত অংশগুলাে থাকে- সংগ্রাহক ও এটি প্রতিবর্তি ক্রিয়ার জন্য উদ্দীপনা গ্রহণ করে। এর সাথে একটি সংবেদী স্নায়ু সংযুক্ত থাকে। সংবেদী স্নায়ু ও উদ্দীপকের মাধ্যমে এর ডেনড্রাইট উদ্দীপ্ত হলে সে তাড়না মেরুরজ্জুতে পরিবাহিত হয়। সংযােজক স্নায়ু ও মেরুরজ্জ্বর গ্রে-ম্যাটার অংশে সংবেদী স্নায়ু ও ক্রিয়াজ স্নায়ুর মধ্যবর্তী স্থানে সংযােজক স্নায়ু অবস্থিত।

মোটর স্নায়ু ও এর মাধ্যমে উদ্দীপনা কার্যকারক অঙ্গে (পেশি বা গ্রন্থি) পৌছায়। কার্যকারক ও পেশি বা গ্রন্থি যেখানে প্রতিক্রিয়া প্রকাশ পায়।

প্রতিবর্তি ক্রিয়ার প্রকারভেদঃ প্রতিবর্তি ক্রিয়া মূলতঃ তিন ধরনের। যথা-

নিরপেক্ষ প্রতিবর্তিক্রিয়া

বাহ্য উদ্দীপক প্রয়ােগের সাথে সাথে প্রাণীদেহের স্বতঃস্ফূর্তভাবে যে প্রতিক্রিয়া হয়।যেমন- হঠাৎ উজ্জ্বল আলােতে চোখ বন্ধ হয়ে যাওয়া।

সাপেক্ষ প্রতিবর্তিক্রিয়া

শিখন বা অনুশীলন সাপেক্ষে বিকল্প উদ্দীপকের প্রতি প্রাণীর মূল উদ্দীপকের ন্যায় প্রতিক্রিয়া।

উদাহরণ- প্যাভলভের পরীক্ষায় এর বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে।

ক্রমিক প্রতিবর্তিক্রিয়া

একাধিক প্রতিবর্তি ক্রিয়া সমষ্টিগতভাবে প্রতিক্রিয়া দেখায়। যেমন- ঝাঁঝালাে বস্তুর গন্ধে হাঁচি আসা,হাঁচির ফলে চোখে পানি আসা। এগুলাে একটি উদ্দীপকের ক্রমিক প্রতিক্রিয়া।

মানুষের কয়েকটি প্রতিবর্তি ক্রিয়া

চোখের উপযােজন, হাঁটুর ঝাকুনি, চোখের পিউপিলের সঞ্চালন, হাঁচি, কনুই ঝাকুনি, হাই তােলা ইত্যাদি।

Leave a Comment