শ্রেণীবিন্যাসের ভিত্তি

শ্রেণীবিন্যাসের ভিত্তি

প্রতিটি প্রাণীর নিজস্ব কতকগুলাে বৈশিষ্ট্য বা লক্ষণ থাকে। এ বৈশিষ্ট্যগুলো এদের আকৃতি, গঠন, দৈহিক প্রতিসাম্যতা, দেহের খণ্ডায়ন, দেহ-গহ্বর, লিঙ্গ, জীবনচক্র প্রভৃতির মাধ্যমে প্রকাশিত হয়। শ্রেণীবিন্যাসের প্রয়ােজনে প্রাণিদেহের এসব বৈশিষ্ট্যকে প্রাধান্য দেয়া হয়।

নিচে প্রাণিদের এমন কয়েকটি প্রধান বৈশিষ্ট্যের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেয়া হলাে যেগুলাে শ্রেণীবিন্যাসের ভিত্তি রচনায় অবদান রাখতে সক্ষম।

ক। ভূণস্তর (Germ Layers)

যৌন প্রজনন (Sexual reproduction) এ অংশ গ্রহণকারী প্রাণিসমূহে শুক্রাণু ও ডিম্বাণুর মিলনের ফলে জাইগােট সৃষ্টি হয়।

জাইগােট বার বার বিভাজিত হয়ে পরিস্ফুটনের (Development) মাধ্যমে ভ্রূণ(Embryo) সৃষ্টি করে। ভ্রূণের যে সকল কোষস্তর থেকে ভবিষ্যতের (পরিণত প্রাণীর) বিবিধ কলা এবং বিভিন্ন অঙ্গ পরিস্ফুটিত হয়, তাদের ভ্রূণস্তর বলে। ভ্রূণের কোষগুলাে দুটি অথবা তিনটি স্তরে বিন্যস্ত থাকে।

যে সব প্রাণীর ভ্রূণে দুটি কোষস্তর থাকে তাদের দ্বিস্তরবিশিষ্ট (Diploblastic) প্রাণী বলে। অপরদিকে যে সব প্রাণীর ভূণে কোষগুলাে তিনটি স্তরে সজ্জিত থাকে, তাদের বলে ত্রিস্তরবিশিষ্ট (Triploblastic) প্রাণী।

খ। প্রতিসাম্য (Symmetry)

প্রাণিদেহের বিভিন্ন অঙ্গের সুষম বন্টনকে প্রতিসাম্য বলে। অধিকাংশ প্রাণীর দেহই প্রতিসাম্য প্রদর্শণ করে।প্রতিসাম্য প্রধানত নিম্নবর্ণিত চার ধরনের।

(১) গােলীয় প্রতিসাম্য (Spherical symmetry)

গােলীয় প্রতিসাম্যও একটি গােলককে যেভাবে কেন্দ্রের মধ্য দিয়ে অতিক্রান্ত যে কোনাে তল বরাবর সমান অংশে ভাগ করা যায় তেমনিভাবে কোনাে প্রাণিদেহকে যদি ভাগ করা যায়, তাকে গােলীয় প্রতিসাম্য বলে। কয়েক ধরনের ভাসমান বা গড়ান প্রােটোজোয়ায় (এককোষী প্রাণী) এ প্রতিসাম্য দেখা যায়।

(২) অরীয় প্রতিসাম্য (Radial symmetry)

কোনাে প্রাণীর দেহকে যদি কেন্দ্রীয় অক্ষ বরাবর কেটে দুই বা দুইয়ের বেশী সংখ্যক সমান অংশে ভাগ করা যায়, তবে সে ধরনের প্রতিসাম্যকে অরীয় প্রতিসাম্য বলে। উদাহরণ- হাইড্রা, সমুদ্র তারা ইত্যাদি।

(৩) দ্বিপার্শ্বীয় প্রতিসাম্য (Bilateral symmetry)

ও যদি কোনাে প্রাণীর দেহকে তার কেন্দ্রীয় অক্ষ বরাবর শুধু একবার দুটি সমান অংশে ভাগ করা যায়, তখন তাকে দ্বিপার্শ্বীয় প্রতিসাম্য বলে। উদাহরণ তেলাপােকা, ব্যাঙ, মানুষ প্রভৃতি।

(৪) অপ্রতিসাম্য (Asymmetry)

যখন কোনাে প্রাণীর দেহকে অক্ষ বরাবর ছেদ করলে একবারও সমান দুটো অংশে ভাগ করা যায় না তখন তাকে অপ্রতিসাম্য বলে। উদাহরণ— অ্যামিবা, স্পঞ্জ, শামুক ইত্যাদি।

গ। খন্ডকায়ন (Metamerism)

কোনাে প্রাণীর দেহ যদি একই রকম খণ্ডাংশ দিয়ে গঠিত থাকে তখন এ অবস্থাকে খন্ডকায়ন বলে।

খন্ডকায়ন দু’রকম- বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ । অঙ্গরীযুক্ত (Annelida) প্রাণীতে (যেমন- কেঁচো) বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ উভয় প্রকারের খন্ডকায়ন পাওয়া যায়। খন্ডকায়নের ফলে এদের দেহ অসংখ্য ছােট ছােট কুঠুরীতে বিভক্ত হয়ে পড়ে।

সন্ধিপদ (Arthropoda) প্রাণীতে (যেমন- আরশােলা) শুধুমাত্র বাহ্যিক খন্ডকায়ন দেখা যায়। শামুক, সমুদ্রতারা প্রভৃতি প্রাণীর কোনাে খন্ডকায়ন থাকে । মেরুদণ্ডী প্রাণীতে বাহ্যিক খন্ডকায়ন অবলুপ্ত হলেও কশেরুকা (Vertebrae) এবং স্নায়ু গ্যাংগ্লিয়া (Nerve gangla)-অভ্যন্তরীণ খন্ডকায়নের স্বাক্ষর বহন করে।

ঘ। প্রান্তিকতা (Polarity)

একটি প্রাণিদেহের বিভিন্ন অঞ্চল নির্দেশ করতে কতকগুলাে বিশেষ শব্দ ব্যবহৃত হয়। নিচে শব্দগুলাে উল্লেখ করা হলাে।

প্রায়ােগিত শব্দ   নির্দেশিত অংশ

সম্মুখ (Anterior) মাথার প্রান্ত বা প্রান্তের দিক

পশ্চাৎ (Posterior) লেজের প্রান্ত বা প্রান্তের দিক

পৃষ্ঠীয় (Dorsal)পিঠ বা পৃষ্ঠভাগ

অংকীয় (Ventral) পেট বা তলদেশ

পার্শ্বীয় (Lateral)একপাশ বা পাশের দিক

মধ্যগ বা স্যাজিট্যাল (Sagittal)দেহের মধ্যরেখা

নিকটবর্তী (Proximal)দেহের কেন্দ্রীয় অংশের কাছাকাছি বা অংশমুখী

দূরবর্তী (Distal) দেহের নির্দিষ্ট অংশের দূরবর্তী অংশ।

বক্ষীয় (Pectoral)বক্ষ অঞ্চল বা অগ্রপদ অবলম্বন দানকারী অঞ্চল

শ্রোণীয় (Pelvic)নিতম্ব অঞল বা পশ্চাৎপদ অবলম্বন দানকারী অঞ্চল

ঙ। সিলােম (Coelom) )

সিলােম বা দেহগহ্বরের উপস্থিতি ও অনুপস্থিতি এবং গঠনের বিভিন্নতা শ্রেণীবিন্যাসের ক্ষেত্রে আরেকটি প্রয়ােজনীয় প্রাণী চরিত্র। সিলােম বলতে সাধারণত বহুকোষী প্রাণিদের পৌষ্টিকনালী এবং দেহপ্রাচীরের মধ্যবর্তী ফাঁকা অঞলটি বুঝায়। এ গহ্বরের মধ্যে দেহের বিভিন্ন অভ্যন্তরীণ অঙ্গ অবস্থান করে। সিলােমের প্রকৃতির উপর ভিত্তি করে প্রাণিদের নিম্নোক্ত গােষ্ঠীতে ভাগ করা যায়-

(১) অ্যাসিলােমেট (Acoelomate)

ও জেলীফিশ (নিডেরিয়া), চ্যাপ্টা কৃমি (প্রাটিহেলমিথিস্)-র অন্ত্র এবং অন্যান্য অভ্যন্তরীণ অঙ্গ সম্পূর্ণরূপে নিরেটভাবে কোষ বা কলায় পরিবৃত থাকে। এদের কোনাে সিলােম থাকে না। এ ধরনের প্রাণিদের অ্যাসিলােমেট বলে।

(২) অপ্রকৃত-সিলােমট (Pseudocoelomate)

কেঁচো-কৃমির (Round worm) যে দেহগহ্বর থাকে তা মেসােডার্মাল আস্তরণে আবৃত নয়, তাই একে অপ্রকৃত বা সিউডােসিলােম বলে। এ ধরনের তথাকথিত সিলােমযুক্ত প্রাণিদের অপ্রকৃত সিলােমেট বলে।

(৩) প্রকৃত-সিলােমেট (Eucoelomate)

প্রকৃত-সিলােমেট ও অপেক্ষাকৃত উন্নত প্রাণিতে মেসােডার্মের অভ্যন্তর থেকে গহ্বররূপে সিলােম উদ্ভূত হয়। এটিই প্রকৃত সিলােম। এ ধরনের সিলােমধারী প্রাণিদের প্রকৃত সিলােমেট বলে।

মেসােডার্মের অভ্যন্তরে পরিস্ফুটিত গহ্বরটি চাপা, মেসােডার্মাল এবং এপিথেলিয়াল কোষে গঠিত একটি স্তরে আবৃত থাকে একে পেরিটোনিয়াম (Peritoneum)

শ্রেণীবিন্যাসে ব্যবহৃত প্রধান এককগুলাের সংজ্ঞা

প্রজাতি (Species): প্রজাতি হলাে শ্রেণীবিন্যাসের কার্যকরী একক। প্রজাতি এমন একটি জীবগােষ্ঠী যারা ভৌগােলিক ও পরিবেশগত কারণে একে অন্য থেকে পৃথক থাকলেও পরস্পর যৌন মিলন দ্বারা প্রজননক্ষম সন্তান জন্ম দিতে সক্ষম—Mayr 1976।

গণ (Genus): পরস্পর সম্পর্কযুক্ত কয়েকটি প্রজাতিকে নিয়ে গঠিত জীব গােষ্ঠীকে গণ বলে, যেমন মানুষের গণ হলাে Horno (হােমাে)।

গােত্র (Family): পরস্পর সম্পর্কযুক্ত কয়েকটি গণকে নিয়ে গঠিত গােষ্ঠীকে বলে গােত্র। যেমন- মানুষের গােত্র হলাে Hominidae (হােমিনিডি)।

বর্গ (Order): পরস্পর সম্পর্কযুক্ত কয়েকটি গােত্রকে নিয়ে গঠিত গােষ্ঠীকে বলে বর্গ। যেমন মানুষের বর্গ হলাে Primates (প্রাইমেট)।

শ্ৰেণী (Class) : পরস্পর সম্পর্কযুক্ত কয়েকটি বর্গ নিয়ে গঠিত গােষ্ঠীকে শ্ৰেণী বলে। যেমন মানুষের শ্রেণী হলাে Mammalia (ম্যামালিয়া)।

পর্ব (Phylum): পরস্পর সম্পর্কযুক্ত কয়েকটি শ্রেণী নিয়ে গঠিত গােষ্ঠীকে বলে পর্ব। যেমন- মানুষের পর্ব হলাে Chordata (কর্ডাটা)

Leave a Comment