শ্বাস ক্রিয়া।অক্সিজেন ও কার্বন ডাই অক্সাইড পরিবহন

শ্বাস ক্রিয়া

যে প্রক্রিয়ায় ফুসফুসে অক্সিজেন সমৃদ্ধ বায়ু প্রবেশ করে এবং কার্বন ডাইঅক্সাইড সমৃদ্ধ বায়ু ফুসফুস থেকে বের হয়ে যায় তাকে শ্বাসক্রিয়া (Breathing) বলে।

পালমোনারি ভেন্টিলেশন

নির্দিষ্ট সময়ে যে আয়তনের বায়ু ফুসফুসের মধ্যে আসা-যাওয়া করে তাকে ফুসফুসীয় বায়ুপ্রবাহ বা পালমােনারি ভেন্টিলেশন বলে।

৭৫ কেজি ওজন বিশিষ্ট বয়স্ক মানুষে প্রতি মিনিটে ১২ বার প্রশ্বাস-নিশ্বাস সংঘটিত হয়। এ সময়ে ফুসফুসের মধ্যে প্রায় ৬ লিটার বায়ু আসা-যাওয়া করে। বক্ষ ও উদর গহবরের মধ্যবর্তী পেশি, অনুপ্রস্থ পর্দা (ডায়াফ্রাম) এবং পর্শুকার (Ribs) মধ্যবর্তী স্থানসমূহে বিদ্যমান ইন্টারকস্টাল পেশির যুগপৎ সংকোচন-শ্লথনে শ্বসনক্রিয়া সংঘটিত হয়। মানুষের শ্বসন কৌশল দুটি পর্যায়ে সম্পন্ন হয়। যথা- (ক) শ্বাস গ্রহণ ও (খ) শ্বাস ত্যাগ।

(ক) শ্বাস গ্রহণ বা প্রশ্বাস (Inspiration)

এ প্রক্রিয়ায় ডায়াফ্রাম সংকুচিত হয়ে নিচের দিকে নেমে যায় এবং পশুকার ইন্টারকস্টাল পেশিগুলাে সংকুচিত হয়ে পশুকাগুলােকে বাহির দিকে ও উপরের দিকে ঠেলে দেয়। ফলে বক্ষ গহবর দৈর্ঘ্য ও প্রস্থে প্রসারিত হয়। বক্ষ গহ্বরের আয়তন বেড়ে যাওয়ায় অন্তঃপুরা (Intrapleura) অঞ্চলের চাপ কমে যায়।

কিন্তু ফুসফুস মধ্যস্থ চাপ বেশি থাকায় ফুসফুস দুটি প্রসারিত হয়, ফলে পরিবেশ থেকে অক্সিজেন সমৃদ্ধ বাতাস নাসারন্ধ্র → নাসাপথ →নাসাগলবিল → ল্যারিংক্স ট্রাকিয়া ব্রঙ্কাস হয়ে ফুসফুসের ব্রঙ্কিওলের মাধ্যমে অ্যালভিওলিতে প্রবেশ করে। অ্যালভিওলিতে অক্সিজেনের চাপ এদের বেষ্টনকারী রক্তজালকের অক্সিজেনের চাপ হতে বেশি হওয়ায় অক্সিজেন রক্তজালকে প্রবেশ করে এবং সেখান হতে রক্তপ্রবাহের মাধ্যমে কোষে চলে যায়।

(খ) শ্বাস ত্যাগ বা নিঃশ্বাস (Expiration)

প্রশ্বাসের পরপরই এটি সংঘটিত হয়। নিশ্বাসকালে ডায়াফ্রাম ও ইন্টারকস্টাল পেশির শ্বসন হলে ডায়াফ্রাম ও বক্ষগহবর পূর্বের অবস্থায় ফিরে আসে। এতে বক্ষ গহ্বরের আয়তন কমে যায় এবং এর ভেতরের চাপ বৃদ্ধি পায়।

ফলে ফুসফুসের ভেতরে বাতাসের উপর চাপ পড়ে এবং কার্বন ডাইঅক্সাইড যুক্ত বাতাস অ্যালভিওলি → ব্রঙ্কিউল → ব্রঙ্কাস → ট্রাকিয়া → ল্যারিংক্স → নাসাগলবিল ও নাসাপথ হয়ে নাসারন্ধ্রপথে বাহিরে নিষ্ক্রান্ত হয়।

শ্বাসহার : প্রতিটি প্রশ্বাস-নিশ্বাসে গৃহীত অক্সিজেন ও উৎপন্ন কার্বন ডাইঅক্সাডের অনুপাতকে শ্বাসহার বলে।

বায়ুমাত্রা বা টাইডাল ভলিউম (Tidal Volume) : স্বাভাবিক শ্বাসকার্যের সময় প্রতিবারে যে আয়তনের বাতাস ফুসফুসে আসা-যাওয়া করে তাকে বায়ুমাত্রা বলে। স্বাভাবিক অবস্থায় বায়ুমাত্রা = ৫০০ মিলিলিটার।

শ্বসন মিনিট ভলিউম (Respiratory Minute Volume RMV) : বায়ুমাত্রাকে প্রতি মিনিটে সংঘটিত নিশ্বাস-প্রশ্বাসের সংখ্যা দ্বারা গুণ করে শ্বসন মিনিট ভলিউম পাওয়া যায়।

RMV = ৫০০ মি.লি x১২ = ৬,০০০ মি.লি= ৬ লিটার

অক্সিজেন ও কার্বন ডাই অক্সাইড পরিবহন

শ্বসনের সময় পরিবেশ থেকে অক্সিজেন ফুসফুসে প্রবেশ করার পর রক্তের মাধ্যমে দেহের প্রতি কোষে পৌছে।কোষস্থ খাদ্যকে জারিত করে জৈব শক্তি ও কার্বন ডাইঅক্সাইড (CO,) উৎপন্ন করে। উৎপন্ন কার্বন ডাইঅক্সাইড রক্তের মাধ্যমে ফুসফুসে আসে এবং প্রশ্বাসের সময় দেহ থেকে নির্গত হয়। কাজেই অক্সিজেন ও কার্বন ডাই অক্সাইড পরিবহন একটি জটিল প্রক্রিয়া।

এটি শ্বসনতন্ত্র ও রক্ত সংবহন তন্ত্রের যৌথ ক্রিয়ার উপর নির্ভরশীল। নিম্নে রক্তের মাধ্যমে অক্সিজেন ও কার্বন ডাইঅক্সাইড এর পরিবহন বর্ণনা করা হলাে-

অক্সিজেন পরিবহন: (Transportation of Oxygen)

রক্তের মাধ্যমে দু’ভাবে কোষে অক্সিজেন পরিবাহিত হয়। ৯৭-৯৮% অক্সিজেন পরিবাহিত হয় লােহিত কণিকার হিমােগ্লোবিনের সাথে রাসায়নিক বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে অক্সিহিমােগ্লোবিন হিসেবে এবং ২-৩% পরিবাহিত হয় প্লাজমায় দ্রবীভূত হয়ে। প্রতিটি হিমােগ্লোবিন অণু ৪টি লৌহ যুক্ত হিম ও ৪টি গ্লোবিনের সমন্বয়ে গঠিত।

একটি করে লৌহ অণু প্রতিটি হিম গ্রুপের কেন্দ্রে অবস্থান করে এবং প্রতিটি লৌহ অণুর সাথে একটি করে অক্সিজেন অণুযুক্ত হতে পারে। ফলে একটি হিমােগ্লোবিন অণু একই সাথে ৪টি অক্সিজেন অণুর সাথে যুক্ত হতে পারে। অক্সিজেনের সাথে হিমােগ্লোবিনের রাসায়নিক বিক্রিয়া উভমুখী।হিমােগ্লোবিন+অক্সিজেন= অক্সিহিমােগ্লোবিন হিমােগ্লোবিনের সাথে অক্সিজেন এর পরিমাণ বেশি থাকলে অক্সিজেন ও হিমােগ্লোবিন মিলে HbO2 তৈরি করবে। আবার অক্সিজেনের পরিমাণ যেখানে কম সেখানে HbO2 ভেঙ্গে অক্সিজেন এবং হিমােগ্লোবিন পৃথক হবে।

ফুসফুসের অ্যালভিওলাসের প্রাচীর গাত্রের কৈশিক জালকে অক্সিজেন এর পরিমাণ বেশি। ফলে অক্সিজেন এবং Hb যুক্ত হয়ে HbO2 উৎপন্ন করে এবং সংবহনতন্ত্রের মাধ্যমে পরিবাহিত হয়ে দেহকোষের কাছে আসে। দেহকোষে যেহেতু অক্সিজেনের পরিমাণ কম তাই HbO2 ভেঙ্গে অক্সিজেন মুক্ত হয়ে ব্যাপন প্রক্রিয়ায় কোষে প্রবেশ করে।

কার্বন ডাইঅক্সাইড পরিবহন (Transportation of carbon dioxide)

দেহের কলাকোষে বিপাকীয় কাজে উৎপন্ন CO2 ব্যাপন প্রক্রিয়ায় কলাকোষ থেকে শিরাজালকের রক্তে প্রবেশ করে রক্ত রসের পানিতে 02 এর তুলনায় Co2 দ্রবীভূত হওয়ার ক্ষমতা অনেক বেশি। তা সত্ত্বেও রক্তের নির্দিষ্ট ক্ষারীয় প্রকৃতি বজায় রাখার জন্য রক্তরসের সাথে ৫% CO2 মিশ্রিত হয়ে কার্বনিক এসিড তৈরি করে রক্তে পরিবাহিত হয়। কার্বনিক এসিড পরে বিশ্লিষ্ট হয়ে H ও HCO; আয়ন উৎপন্ন করে। CO2 ৪০-৪৫% লােহিত রক্ত কণিকার হিমােগ্লোবিনের সাথে মিশে কার্বামিনাে হিমােগ্লোবিন রূপে রক্তে পরিবাহিত হয়।

কার্বন ডাইঅক্সাইড+পানি=কার্বনিক এসিড।বাকী ৫০% CO2 লােহিত রক্ত কণিকার সাইটোপ্লাজমে অবস্থিত পানির সাথে মিশে কার্বনিক এসিড (HCO3) রূপে পরিবাহিত হয়। কাবনিক এসিড বিশ্লিষ্ট হয়ে H’ ও HCO3 আয়ন সৃষ্টি করে। উৎপন্ন হাইড্রোজেন হিমােগ্লোবিনের প্রােটিন অংশের সাথে যুক্ত হয়। ফলে রক্তের ক্ষারধর্ম অক্ষুন্ন থাকে।

অন্যদিকে বাইকার্বনেট আয়ন লােহিত রক্ত কণিকা থেকে রক্তরসে চলে আসে। উল্লিখিত উপায়ে CO2 শিরা রক্তের মাধ্যমে পরিবাহিত হয়ে ফুসফুসে পৌছে ব্যাপন প্রক্রিয়ায় ফুসফুসের অ্যালভিওলাস প্রবেশ করে।

শ্বাস রঞ্জক (Respiratory Pigment)

রক্তের যে অংশ দ্বারা শ্বসন গ্যাস, বিশেষ করে অক্সিজেন পরিবাহিত হয় তাকে শ্বাস রঞ্জক বলে। হিমােগ্লোবিন এক ধরনের শ্বাস রঞ্জক। হিমােগ্লোবিন লােহিত রক্ত কণিকার সাইটোপ্লাজমে অবস্থিত গ্লোবিউলার প্রােটিন। প্রতিটি হিমােগ্লোবিন ৯৬% সরল প্রােটিন গ্লোবিন এবং ৪% লৌহ ধারণকারী রঞ্জক ‘হিম’ এর সমন্বয়ে গঠিত। ইরাইথ্রোসাইট এর সাইটোপ্লাজমে হিমােগ্লোবিন নামক অক্সিজেন বাহক পদার্থ থাকার কারণে ইরাইথ্রোসাইটকে রঙিন দেখায়। তাই এদেরকে লােহিত রক্তকণিকা বলে।

Leave a Comment