শুক্রাণু ও ডিম্বানুর গঠন।নিষেক।গর্ভধারন

মানুষের শুক্রাণুর গঠন

বিভিন্ন প্রাণীতে শুক্রাণুর আকৃতি বিভিন্ন হয়। প্রধানতঃ এরা সরু, দীর্ঘাকার এবং লম্বা লেজ যুক্ত। অধিকাংশ প্রাণীর শুক্রাণু ক্ষুদ্র ও আণুবীক্ষণিক। মানুষের শুক্রাণুর ব্যাস ২.৫ মাইক্রন এবং দৈর্ঘ্য প্রায় ৫০-৭০ মাইক্রন। শুক্রাণুর দেহ প্রধানতঃ তিনটি অংশে বিভক্ত।

i. মস্তক (Head)

শুক্রাণুর সম্মুখ ভাগের উপবৃত্তাকার অংশকে মাথা বা মস্তক বলে। মস্তকে তুলনামূলক ভাবে বড় একটি নিউক্লিয়াস থাকে এবং নিউক্লিয়াসে হ্যাপ্লয়েড সংখ্যক ক্রোমােসােম থাকে। মস্তকের অগ্রপ্রান্তে টুপির ন্যায় থলি বিশেষ অ্যাক্রোসােম নামক একটি গঠন থাকে। অ্যাক্রোসােমে উপস্থিত টিস্যু গলনকারী এনজাইমসমূহ ডিম্বাণুর ঝিল্লী ভেদ করে ভেতরে প্রবেশে সাহায্য করে।

ii. গ্রীবা (Neck)

শুক্রাণুর মাথার পিছনে খাটো, সরু অংশকে গ্রীবা বলে। এখানে পরস্পরের সাথে সমকোণে দুটি সেন্ট্রিওল (প্রক্সিমাল সেন্ট্রিওল ও ডিস্টাল সেন্ট্রিওল) থাকে। অগ্র বা প্রক্সিমাল সেন্ট্রিওল (proximal centriole) নিউক্লিয়াসের সাথে ডিম্বাণুতে গমন করে এবং নিষেক পরবর্তী মাইটোসিস স্পিন্ডল (mitosis spindle) গঠনে সাহায্য করে। পশ্চাৎ বা ডিস্টাল সেন্ট্রিওল থেকে অক্ষীয় তন্তু (axial filament) সৃষ্টি হয়ে লেজের পশ্চাৎ প্রান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত।

iii. লেজ (Tail)

গ্রীবার পিছনে অবস্থিত শুক্রাণুর সবচেয়ে লম্বা অংশটি লেজ নামে পরিচিত। লেজের প্রথম অংশটিকে মধ্যম অংশ (middle piece) বলে। মধ্যম অংশে অসংখ্য মাইটোকন্ড্রিয়া অক্ষীয় তন্তুকে সর্পিলাকারে ঘিরে থাকে। লেজের শেষ প্রান্তের কিছু অংশে প্লাজমা পর্দা থাকে না। লেজে একজোড়া মাইক্রোটিউবিউলকে ঘিরে নয় জোড়া মাইক্রোটিউব্যুল(microtubule) থাকে। লেজ শুক্রাণুর চলনে সহায়তা করে ।

মানুষের ডিম্বাণুর গঠন

স্ত্রী জননকোষের নাম ডিম্বাণু। এটি মােটামুটি গােলাকার এবং ১২০-১৫০ মাইক্রন ব্যাসবিশিষ্ট। ডিম্বাশয়ের গ্রাফিয়ান ফলিকলের উওসাইট (oocyte) বিভিন্ন ধাপ অতিক্রম করে পরিপক্ক ডিম্বাণুতে পরিণত হয়। প্রতিটি পরিপক্ক ডিম্বাণুকে তিনটি অংশে ভাগ করা যায়। যথা- (ক) ডিম্বাণু ঝিল্লী, (খ) নিউক্লিয়াস ও (গ) সাইটোপ্লাজম।

i. ডিম্বাণু ঝিল্লি (Egg membrane)

লিপােপ্রােটিন সমৃদ্ধ প্লাজমা মেমব্রেন দ্বারা ডিম্বাণু আবৃত থাকে। প্লাজমা মেমব্রেনের বাইরে জোনা পেলুসিডা (zona pellucida) নামক একটি প্রাইমারি আবরণ বিদ্যমান। প্রাইমারি আবরণীর বাইরে আবার করােনা রেডিয়েটা (corona radiata) নামক একটি সেকেন্ডারি আবরণ থাকে।

ii. সাইটোপ্লাজম (Cytoplasm)

ডিম্বাণুর সাইটোপ্লাজম উওপ্লাজম (ooplasm) নামে পরিচিত।

এতে প্রচুর গলগিবডি,মাইটোকন্ড্রিয়া,এন্ডােপ্লাজমিক রেটিকুলাম ও কর্টিক্যাল গ্রানিউল (Cortical granule) থাকে। মানুষের ডিম্বাণুতে কুসুমের পরিমাণ অতি সামান্য। কুসুম সাইটোপ্লাজমে সমানভাবে ছড়ানাে থাকে। তাই মানুষের ডিম্বাণুকে মাইক্রোলেসিথাল ডিম্বাণু (microlecithal egg) বলে।

iii. নিউক্লিয়াস (Nucleus)

ডিম্বাণুর নিউক্লিয়াস বেশ বড়, তবে কেন্দ্র থেকে একটু সরে অবস্থান করে। নিষেকের সময় নিউক্লিয়াসটি কেন্দ্রে আসে। এতে হ্যাপ্লয়েড সংখ্যক (n) ক্রোমােসােম থাকে।

নিষেক

যে প্রক্রিয়ায় ডিম্বাণু ও শুক্রাণু মিলিত হয়ে এদের হ্যাপ্লয়েড (n) ক্রোমসােমবাহী নিউক্লিয়াসের মিলন ঘটিয়ে ডিপ্লয়েড ক্রোমসােমবিশিষ্ট জাইগােট গঠন করে তাকে নিষেক বলে।

নিষেক একটি বিশেষ জৈবিক প্রক্রিয়া। নিষেক ডিম্বাণুকে পরিস্ফুটনের জন্য সক্রিয় করে তােলে। নিষেক প্রজাতি নির্দিষ্ট (species specific) অর্থাৎ কেবল একই প্রজাতির ডিম্বাণু ও শুক্রাণুর মধ্যে নিষেক ঘটে। ডিম্বাণু শুক্রাণু দ্বারা একবারই নিষিক্ত হয়।

মানুষের নিষেক স্ত্রীর ডিম্বনালি বা ফেলােপিয়ান নালিতে সংঘটিত হয়। যৌন মিলনের সময় বীর্যের (semen) সাথে অসংখ্য শুক্রাণু জরায়ুতে প্রবেশ করে কিন্তু কেবল একটি শুক্রাণু নিষেক ক্রিয়ায় সফল হয়। প্রতিবার সঙ্গমে ১.৫-৪ মিলিলিটার বীর্য ক্ষরিত হয় এবং এতে প্রায় ৪০-১০০ মিলিয়ন (৪-১০ কোটি) শুক্রাণু থাকে। যৌন মিলনের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে নিষেক সংঘটিত না হলে শুক্রাণু মারা যায়।

নিষেকের সময় সংঘটিত ঘটনাবলি

ক) নিষেকযােগ্য ডিম্বাণুটি প্রকৃতপক্ষে একটি সেকন্ডারি উওসাইট। এটি করােনা রেডিয়েটা (coronal radiata) নামক কয়েক স্তর ফলিকল কোষ এবং জোনা পেলুসিডা (zona pellucida) আবরণ দ্বারা আবৃত থাকে।

খ) একটি শুক্রাণু সেকেন্ডারি উওসাইটের কাছাকাছি পৌঁছালে শুক্রাণুর অ্যাক্রোসােম পর্দা ফেটে গিয়ে হায়ালুরােনিডেজ (hyaluronidase) ও প্রােটিয়েজ এনজাইম মুক্ত হয়।

গ) এনজাইমদ্বয় উওসাইটের আবরণী পর্দাকে হজমের মাধ্যমে রাস্তা তৈরি করে। ফলে শুক্রাণু আবরণী ভেদ করে উওসাইটের প্লাজমামেমব্রেন পর্যন্ত প্রবেশ করে।

ঘ) অতঃপর শুক্রাণুর মাথা প্লাজমামেমব্রেন ভেদ করে উওসাইটের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে এবং লেজ বাইরে পরিত্যক্ত হয়।

ঙ) উওসাইটের অভ্যন্তরে শুক্রাণুর মাথা প্রবেশের সাথে সাথে দ্রুত একটি বিক্রিয়া সংঘটিত হয়। এ বিক্রিয়ায় উওসাইটের কর্টিকাল দানার সাথে জোনা পেলুসিডা মিলে উওসাইটের চারিদিকে নিষেক পর্দা সৃষ্টি করে। এতে দ্বিতীয় কোন শুক্রাণু উওসাইটে প্রবেশ করতে পারে না।

চ) শুক্রাণুর প্রবেশ সেকেন্ডারি উওসাইটের নিউক্লিয়াসে দ্বিতীয় মায়ােটিক বিভাজন ঘটায়। ফলে একটি পূর্ণাঙ্গ হ্যাপ্লয়েড ডিম্বাণু ও একটি দ্বিতীয় পােলার বডি তৈরি হয়। এ অবস্থায় ডিম্বাণু ও শুক্রাণুর হ্যাপ্লয়েড নিউক্লিয়াসকে প্রােনিউক্লিয়াস বলে।

ছ) প্রােনিউক্লিয়াসদ্বয় অতঃপর কাছাকাছি আসে, মিলিত হয় এবং ডিপ্লয়েড জাইগােট (২n) গঠন করে।

গর্ভধারণ/ইমপ্লান্টেশন

ডিম্বাণু নিষেকের পরপরই জাইগােটে কোষ বিভাজন শুরু হয়। কোষ বিভাজনকে ক্লিভেজ(cleavage) বলে। ক্লিভেজের ফলে প্রথম মরুলা (morula), অতঃপর ব্লাস্টুলা (blastula) সৃষ্টি হয়। ব্লাস্টুলা গঠনকারী কোষকে ব্লাস্টোমিয়ার (blastomere), ভেতরের গহ্বরকে ব্লাস্টোসিল (blastocoel), বাইরের আবরণ সৃষ্টিকারী ব্লাস্টোমিয়ারকে ট্রোফোব্লাস্ট (trophoblast) এবং ভেতরের সমবেত কোষ গুচ্ছকে অন্তঃস্থ কোষগুচ্ছ (inner cell mass)বলে।

এ অবস্থায় গঠনটি ব্লাস্টোসিস্ট (blastocyst) নামে পরিচিত। ফেলােপিয়ান নালি অতিক্রমকালে ব্লাস্টোসিস্ট গঠিত হয়। ব্লাস্টোসিস্ট জরায়ুতে পৌছার পর জোনা পেলুসিডা অবলুপ্ত হয় এবং নিষেকের ৬-৯ দিনের মধ্যে ব্লাস্টোসিস্টটি এন্ডােমেট্রিয়ামে প্রােথিত হয়। ব্লাস্টোসিস্ট এন্ডােমেট্রিয়ামে প্রােথিত বা রােপিত হওয়ার পদ্ধতিকে ইমপ্লান্টেশন বলে।

গর্ভধারণের পর ট্রফোব্লাস্ট দুটি স্তরে বিভক্ত হয়। বাইরের স্তরকে কোরিওন(chorion) বলে। কোরিওন থেকে এন্ডােমেট্রিয়ামের অভ্যন্তর ভাগে আঙ্গুলের ন্যায় অভিক্ষেপ সৃষ্টি হয়। অভিক্ষেপগুলােকে কোরিওনিক ভিলাই (choronic villi) বলে। কোরিওনিক ভিলাই এর মাধ্যমেই জরায়ু ও ট্রোফোব্লাস্টের মধ্যে পুষ্টি, অক্সিজেন ও বর্জ্য পদার্থের আদান প্রদান ঘটে। পরবর্তীতে প্লাসেন্টা দ্বারা এ কাজটি সম্পাদিত হয়।

Leave a Comment