শিখন আচরণ।Pavlov-এর তত্ত্ব

শিখন আচরণ

প্রতিটি প্রাণীই কতকগুলাে সহজাত আচরণ এবং প্রতিবর্তি ক্রিয়ার ক্ষমতা নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। এসব জন্মগত সামর্থ্য পরিবর্তনশীল পরিবেশের সাথে সামঞ্জস্য বিধান করে চলার পক্ষে সবসময় পর্যাপ্ত নয়।

বয়স বাড়ার সাথে সাথে এবং পরিবর্তিত পরিমণ্ডলে সাফল্যের সাথে টিকে থাকার জন্য প্রায় প্রতিটি প্রাণীকেই নতুন কিছু আচরণ আয়ত্ত করতে হয়।

অতীত অভিজ্ঞতাই প্রাণীকে নতুন কিছু আয়ত্ত করতে ও নতুন আচরণ প্রদর্শণ করতে সাহায্য করে।

জন্মের পর থেকে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত প্রাণীর অতীত অভিজ্ঞতা ও অনুশীলনের মাধ্যমে নতুন আচরণ আয়ত্ত করাকে শিখন বলা যেতে পারে।

শিখনের সংজ্ঞা

বিভিন্ন বিজ্ঞানী শিখনের ভিন্ন ভিন্ন সংজ্ঞা দিয়েছেন।

মার্কিন বিজ্ঞানী জে. এ. ম্যাকগােচ (McGoach)শিখনের সংজ্ঞাতে বলেছেন,

“শিখন হলাে অভ্যাসের ফলে ক্রিয়ার পরিবর্তন।”

আবার ওয়াটসন (Watson) ও বার্নার্ড(Bernard) এর মতে,

“শিখন হলাে আচরণের পরিবর্তন।”

সি.টি. মর্গান (C.T. Morgan) ও আর. এ. কিং (R.A.King)১৯৬৬ সালে শিখনের সর্বাধিক গ্রহণযােগ্য সংজ্ঞা দিয়েছেন,

“অতীত অভিজ্ঞতা বা অনুশীলনের ফলে আচরণের অপেক্ষাকৃত স্থায়ী পরিবর্তনকে শিখন বলে।”

শিখন আচরণ এর বৈশিষ্ট্য

১। এ আচরণ প্রদর্শনের জন্য অভিজ্ঞতার প্রয়ােজন হয়।

২। উদ্দীপক ও প্রতিক্রিয়ার মধ্যে নতুন সম্পর্ক স্থাপন হয়।

৩। শিখন সর্বদা অভিযােজনীয়। এটি সাধারণত উচ্চ শ্রেণির প্রাণীতে দেখা যায়।

৪। প্রজাতি নির্দিষ্ট নয়। একই প্রজাতির প্রাণীদের মাঝে ভিন্ন রকমের অথবা বিভিন্ন প্রজাতির মাঝে একই রকমের শিখন আচরণ পরিলক্ষিত হতে পারে।

৫। শিখন আচরণ সর্বদা পরিবর্তনশীল।

৬। বংশ পরম্পরায় প্রদর্শিত হয়না।

৭। এটি জটিল প্রকৃতির এবং শিক্ষার মাধ্যমে অর্জিত হয়।

শিখন আচরণ এর প্রকারভেদ

বিজ্ঞানীদের মতে শিখন আচরণকে ছয়টি ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। যথা-

১। অভ্যাসগত শিখন

প্রাণীর শিক্ষালাভের সবচেয়ে সহজ উপায় হলাে অভ্যাসগত আচরণ। কোন কোন প্রাণী পুনঃপুনঃ উদ্দীপনায় বার বার সাড়া প্রদান করে। কিন্তু যদি উদ্দীপনা বার বার দেয়া হতেই থাকে তবে সেই উদ্দীপনায় প্রাণী আর সাড়া দেয় না।

যেমন- অভ্যাসগত আচরণের কারণে চামড়া শিল্পকারখানার শ্রমিকরা দুগন্ধময় পরিবেশে কাজ করতে করতে অভ্যস্ত হয়ে পরে।

২। সাপেক্ষণ শিখন

কোন উদ্দীপকের প্রতি শর্তাধীন সাড়া দেয়ার কারণে প্রাণী যে শিখন আচরণ অর্জন করে তাকে সাপেক্ষণ শিখন বলে।

যেমন- খাবার দেয়ার সময় একটি নির্দিষ্ট শব্দ করে পােষা প্রাণীকে নিয়মিত খাবার দেয়া হলে, পরবর্তীতে খাবার না দিয়েও ঐ শব্দ করলে পােষা প্রাণীটি সাড়া প্রদান করে।

৩। পরীক্ষালব্ধ শিখন

ভুল সংশােধনের মাধ্যমে বা তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে প্রাণী যে শিক্ষালাভ করে তাকে পরীক্ষালব্ধ শিখন বলে।

যেমন- ব্যাঙ যদি কখনাে মৌমাছিকে মুখে নিয়ে গিলে ফেলার চেষ্টা করে মৌমাছিটি তখন ব্যাঙের মুখে হুল ফুটিয়ে দেয় এবং ব্যাঙ বুঝতে পারে যে মৌমাছিটি তার খাদ্য নয়।

পরবর্তীতে মৌমাছি দেখলে ব্যাঙ আর তাকে খাওয়ার চেষ্টা করে না।

৪। অনুকরণ শিখন

সচরাচর প্রাণীর জীবনের কোন একটি নির্দিষ্ট সময়ে অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত কিছু অভিজ্ঞতার আলােকে তার আচরণের যে সব হঠাৎ স্থায়ী পরিবর্তন হয় তাকে অনুকরণ শিখন বলে।

যেমন- ডিম ফুটে বের হয়েই হাঁস-মুরগির বাচ্চারা অনুকরণ করে হাটতে শেখে।

৫। প্রচ্ছন্ন বা সুপ্ত শিখন

প্রাণীর মাঝে যখন কোন বৈশিষ্ট্য সুপ্তাবস্থায় থাকে এবং পরবর্তীতে পারিপার্শ্বিক কোন অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সেই বৈশিষ্ট্যের প্রকাশ হয় তখন তাকে প্রচ্ছন্ন বা সুপ্ত শিখন বলে।

যেমন- পাখির বাসা বানানাের প্রবণতা তাদের মাঝে সুপ্তাবস্থায় থাকে কিন্তু প্রজনন কালে তা জাগ্রত হয়।

৬। অন্তদৃষ্টিমূলক শিখন

বিশেষ পরিস্থিতিতে হঠাৎ করে কোন সমাধান খুঁজে নেয়াই হলাে অন্তদৃষ্টিমূলক শিখন।

যেমন- জার্মান মনােবিজ্ঞানী Wolfgang Kohler (1920) শিম্পাঞ্জির ক্ষেত্রে অন্তদৃষ্টিমূলক শিখন আচরণ পরীক্ষা করেন।

পরীক্ষায় দেখেন যে, শিম্পাঞ্জির খাচায় কতগুলাে কাঠের বাক্স এলােমেলাে ভাবে রেখে ওই খাঁচায় শিম্পাঞ্জির নাগালের বাইরে কলা টানিয়ে রাখলে; শিম্পাঞ্জি তার নিজ বুদ্ধি খাটিয়ে বাক্সের উপর বাক্স রেখে তার উপরে দাড়িয়ে কলা পেড়ে খায়।

কুকুরের লালার প্রতিবর্তি ক্রিয়ার উপর বিজ্ঞানী প্যাভলভের পরীক্ষণ কাজ

সাপেক্ষ প্রতিবর্তি মতবাদ ও রাশিয়ার শারীরতত্ত্ববিদ আইভান প্যাভলভের কুকুরের লালা নিঃসরণের পরীক্ষণ শিখন আচরণের এক বিস্ময়কর ঘটনা।

আমরা জানি কুকুরের মুখে মাংসের টুকরা দিলে মুখ গহ্বরে লালা নিঃসৃত হয়। এটা একটি স্বাভাবিক ঘটনা।

কিন্তু বিজ্ঞানী আইভান প্যাভলভ ক্ষুধার্ত কুকুরের মুখে মাংসের টুকরা দেওয়ার ঠিক পূর্ব মুহূর্তে ঘণ্টা বাজান। তিনি এভাবে ঘণ্টা বাজিয়ে সাথে সাথে এক টুকরা মাংস কুকুরকে দিতে থাকেন।

এ কাজটি বার বার করতে থাকেন। এতে প্রতিবারই কুকুরের মুখে লালা নিঃসৃত হতে থাকে।

তিনি প্রতিবারই যান্ত্রিক ব্যবস্থার মাধ্যমে লালা নিঃসরণের মাত্রা পরিমাপ করেন। কাজটি বেশ কয়েকবার (অন্তত ১২ বার) পুনরাবৃত্তির পর হঠাৎ করে মাংসের টুকরা না দিয়ে তিনি কেবল ঘণ্টা বাজান।

এ পর্যায়ে দেখা গেল, কেবল ঘণ্টাধ্বনির প্রতি প্রতিক্রিয়া স্বরূপ কুকুরটি লালা নিঃসরণ করলাে।

এরপর মাংসের টুকরা না দিয়ে প্যাভলভ যতবার শুধু ঘণ্টা বাজালেন ততােবার সাথে সাথে কুকুরের মুখ থেকে লালা নিঃসৃত হলাে। অর্থাৎ ঘণ্টাধ্বনির সাথে কুকুরের লালা নিঃসরণের একটি সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে।

ঘণ্টাধ্বনি এবং মাংসের টুকরার যুগপৎ উপস্থাপনের ফলে এদের মধ্যে এক সংযােগ গড়ে উঠেছে।

এ সংযােগ ব্যবস্থা কুকুরের মস্তিষ্ক স্নায়ুবিক। সংযােগের মাধ্যমে কার্যরত। এরূপ মস্তিষ্কজাত সংযােগ ক্রিয়াকে প্যাভলভ চিরায়ত সাপেক্ষণ নামে আখ্যায়িত করেছেন।

এখানে উল্লেখ্য যে, ঘণ্টাধ্বনি প্রথমে একটি নিরপেক্ষ উদ্দীপক ছিল। কিন্তু ঘণ্টাধ্বনির সাথে মাংসের টুকরাে কয়েকবার উপস্থাপনের ফলে কুকুরটি ঘণ্টাধ্বনির প্রতি লালা নিঃসরণ করতে শিখলাে।

এজন্য ঘণ্টাধ্বনিকে সাপেক্ষ উদ্দীপক এবং ঘণ্টাধ্বনির প্রতি লালা নিঃসরণের ঘটনাকে সাপেক্ষ প্রতিক্রিয়া বলে অভিহিত করেছেন।

সুতরাং বলা যায় যে সাপেক্ষ উদ্দীপকের প্রতি প্রাণী যে প্রতিক্রিয়া করে তাই সাপেক্ষ প্রতিবর্তি ক্রিয়া বা সাপেক্ষণ।

Leave a Comment