লিঙ্গ নির্ধারণ (Sex determination) কৌশল

লিঙ্গ নির্ধারণ (Sex determination) কৌশল

লিঙ্গ নির্ধারণ

লিঙ্গ নির্ধারণ সম্পর্ক ৩টি বিজ্ঞানসম্মত ভ্ৰূণতাত্ত্বিক মতবাদের মধ্যে সিনগ্যামিক লিঙ্গ নির্ধারণ মতবাদ(syngamic sex determination) বর্তমানে প্রায়বিশ্বজনীনভাবে স্বীকৃত। এই মতানুসারে নিষেককালেই লিঙ্গ নির্ধারণ হয়ে যায়। সিনগ্যামিক ভ্রূততাত্ত্বিক লিঙ্গ নির্ধারণ  সম্পর্কে প্রচলিত ক্রিয়া-কৌশলগুলাের মধ্যে ক্রোমােসােম নিয়ন্ত্রিত লিঙ্গ নির্ধারণ (chromosome theory of sex determination) আধুনিক বলে বিবেচনা করা হয়। ক্রোমােসােম নিয়ন্ত্রিত লিঙ্গ নির্ধারণ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মূলত ক্রোমােসােমের সাহায্যে লিঙ্গ নির্ধারিত হয়। ক্রোমােসােম নিয়ন্ত্রিত কলা-কৌশলগুলাের মধ্যে হেটারােগ্যামিসিস বা সেক্স ক্রোমােসােম দ্বারা লিঙ্গ নির্ধারণ (heterogamesis or sex determination by sex chromosome) কৌশলটি প্রধান।

১৮৯১ খ্রিস্টাব্দে Pyrrhocoris নামক কুমড়াে পােকার স্পার্মাটোজেনেসিস পর্যবেক্ষণকালে জার্মান জীববিজ্ঞানী H.Henking লক্ষ করেন যে, অর্ধেক সংখ্যক শুক্রাণুতে একটি ক্রোমােসােম বর্তমান এবং তিনি এই অতিরিক্ত ক্রোমােসােমের নামকরণ করেন X বডি। আমেরিকান জীববিজ্ঞানী Clarenee E. McClung, ১৯০২ খ্রিষ্টাব্দে X ক্রোমােসােমটির লিঙ্গ নির্ধারণে বিশেষ ভূমিকার উল্লেখ করেন।

কারণ, তিনি প্রত্যক্ষ করেন যে, স্ত্রী ঘাসফড়িং (Xiphidium fasciatum) এর দেহ কোষে ২৪টি ক্রোমােসােম থাকে, অথচ পুরুষ ঘাসফড়িং এর দেহ কোষে মাত্র ২৩টি ক্রোমােসােম বর্তমান। এর তিন বছর পর ১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দে আমেরিকান বায়ােলজিস্ট Nettie Stevens বিভিন্ন পতঙ্গের স্পার্মাটোজেনেসিস ও উওজেনেসিসের উপর গবেষণা করে সর্বপ্রথম ক্রোমােসােম দ্বারা লিঙ্গ নির্ধারণের কৌশল সম্পর্কে একটি পূর্ণাঙ্গ বিবরণ প্রদান করেন। প্রায় একই সময়ে এডমন্ড বি.উইলসন কয়েকটি পতঙ্গে একই পদ্ধতিতে লিঙ্গ নির্ধারণের কৌশল বর্ণনা করেন। তাঁদের অভিমত ব্রীজ, গােল্ডস্মীথ ও হুইটিংস নামক প্রখ্যাত বিজ্ঞানীগন সমর্থন করেন।

X ক্রোমােসােমটি লিঙ্গ নির্ধারণে সুস্পষ্ট ভূমিকা পালন করে বলে তাকে সেক্স ক্রোমােসােম বা হেটারােসােম নামে অভিহিত করা হয়।। স্টিভেন্স লক্ষ করেন যে, স্ত্রী পতঙ্গের দেহ কোষে X ক্রোমােসােমসহ সকল ক্রোমােসােম বর্তমান কিন্তু পুরুষ পতঙ্গে X ক্রোমােসােমের কোন হােমােলােগাস সাথী (অর্থাৎ আরেকটি X ক্রোমােসােম) না থেকে ভিন্ন আকৃতির একটি সাথী থাকে। স্টিভেন্স X ক্রোমােসােমের এই নন-হােমােলােগাস সাথীকে Y ক্রোমােসোম নামে অভিহিত করেন।

দেহ কোষের ক্রোমােসােমের প্রকারভেদ

দেহ কোষের ক্রোমােসােম গুলোকে দুইভাগে ভাগ করা যায়। যথা-

১। অটোসােম (Autosome)

দৈহিক বৈশিষ্ট্য নিয়ন্ত্রণকারী ক্রোমােসােমসমূহকে অটোসােম বলা হয়। লিঙ্গ নির্ধারণে এদের প্রত্যক্ষ কোন সম্পর্ক নেই। এদেরকে ইংরেজি ‘A’ দ্বারা চিহ্নিত করা হয় ।

২। সেক্স-ক্রোমােসােম/হিটারােসােম (Sex chromosome/Heterosome)

 লিঙ্গ নির্ধারণের জন্য প্রত্যক্ষভাবে দায়ী ক্রোমােসােম। মহিলাদের গ্যামিটে শুধুমাত্র X ক্রোমােসােম থাকে তাই এদেরকে হােমােগ্যামিটিক সেক্স ও গ্যামিটকে হােমােগ্যামিট বলে।

অপরদিকে পুরুষে দুই ধরনের গ্যামিট সৃষ্টি হয় (X ও Y) তাই এদেরকে হেটারােগ্যামিটিক সেক্স ও গ্যামিটকে হেটারােগ্যামিট বলে। হেটারোগ্যামেটিক লিঙ্গ নির্ধারণ কৌশল

XX-XY পদ্ধতিতে লিঙ্গ নির্ধারণ

এই পদ্ধতিতে মানুষ, ড্রসােফিলা, মাছি ও লিগিয়াস পতঙ্গ এবং মেলানড্রিয়াম, Humulus lupulus,Coccinina indica উদ্ভিদসহ বিভিন্ন জীবে এই প্রক্রিয়ায় লিঙ্গ নির্ধারিত হয়। স্ত্রী জীবে দুইটি X ক্রোমােসােম বিদ্যমান। এদের সংকেত XX। ফলে সকল ডিম্বাণুতে একটি করে X ক্রোমােসােম থাকে। পুরুষদের একটি X ক্রোমােসােম ও একটি Y ক্রোমােসােম থাকে অর্থাৎ এদের সংকেত XY। X ক্রোমােসােম বহনকারী কোন শুক্রাণু যদি ডিম্বাণুকে নিষিক্ত করে তবে অপত্য বংশধর স্ত্রী এবং Y ক্রোমােসােম বহনকারী কোন শুক্রাণু যদি ডিম্বাণু নিষিক্ত করে তবে বংশধর পুরুষ হবে। নিম্নে ক্রসের মাধ্যমে এটি দেখানাে হলাে-

মানুষের লিঙ্গ সংযুক্তি বৈশিষ্ট্য

সেক্স লিঙ্কড জিন (Sex Linked Gene)

মানুষের প্রতি কোষে ২৩ জোড়া ক্রোমােসােম পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ২২ জোড়া অটোসােম যারা দেহের সকল বৈশিষ্ট্য নিয়ন্ত্রণ করে। বাকি এক জোড়া X ও Y ক্রেমােসােম লিঙ্গ নির্ধারণ করে। তাই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যাবলি নিয়ন্ত্রণকারি যে সকল জিন কেবলমাত্র সেক্স ক্রোমােসােমে উপস্থিত থাকে সে সকল জিনকে সেক্স লিঙ্কড জিন (Sex Linked Gene) বলে।

 লিঙ্গ সংযুক্ত বা সেক্স লিংকেড বৈশিষ্ট্য

ক্রোমােসােমের  সেক্স লিঙ্কড জিন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত বৈশিষ্ট্যগুলােকে সেক্স লিঙ্কড বা লিঙ্গ সংযুক্ত বৈশিষ্ট্য (Sex Linked Character) বলে।

X লিংকেড বা সেক্স লিংকেড জিন

সেক্স ক্রোমােসােম বা X ক্রোমােসােমে অবস্থিত জিন গুলােকে সেক্স লিঙ্কড জিন (sex linked gene) বলে।

সেক্স লিঙ্কড প্রচ্ছন্ন জিনের বৈশিষ্ট্য

১। বৈশিষ্ট্য নিয়ন্ত্রণকারি জিন শুধু X ক্রোমােসােমে উপস্থিত থাকে, Y ক্রোমােসােমে থাকে না।

২। মহিলার চেয়ে পুরুষে এ বৈশিষ্ট্য বেশি প্রকাশিত হয়। কারণ মহিলার দুটি X ক্রেমােসােম দুটি প্রচ্ছন্ন জিন হােমােজাইগাস অবস্থায় থাকলে তবেই এর বৈশিষ্ট্য প্রকাশিত হয়। অপরদিকে পুরুষে যেহেতু একটি X ক্রোমােসােম থাকে এবং এতে একটি প্রচ্ছন্ন জিন থাকলেই বৈশিষ্ট্য প্রকাশিত হয়।

৩। সেক্স লিঙ্কড প্রচ্ছন্ন জিন মাতা হতে কন্যা বা পুত্রে সঞ্চারিত হতে পারে। তবে পিতা হতে শুধুমাত্র কন্যাতে সঞ্চারিত হয়, কখনােই পুত্রে সঞ্চারিত হয় না। কারণ পুত্ররা পিতা হতে শুধু Y ক্রোমােসােমপ্রাপ্ত হয় এবং পুত্রের X ক্রোমােসােম শুধু মাতা হতে আসে।

সেক্স লিঙ্কড বংশগতি (sex linked inheritance)

সেক্স ক্রোমােসােম বা X ক্রোমােসােমে অবস্থিত জিনগুলাে X ক্রোমােসােমের মাধ্যমেই বংশ পরস্পর সর্বদা পিতা থেকে কন্যা এবং মাতা থেকে পুত্রে সঞ্চারিত হয়। এ বিশেষ বংশগতিধারার পদ্ধতিকে সেক্স লিঙ্কড বংশগতি (sex linked inheritance) বলা হয়।

সেক্স লিঙ্কড ডিসঅর্ডার (Sex Linked Disorder)

সেক্স লিঙ্কড জিন দ্বারা সৃষ্ট অসুবিধা বা বিশৃঙ্খলাকে সেক্স লিঙ্কড ডিসঅর্ডার বা লিঙ্গ জড়িত অস্বাভাবিকতা বলে। মানুষে এ পর্যন্ত প্রায় ৫৬ ধরনের সেক্স লিঙ্কড ডিসঅর্ডারের সন্ধান পাওয়া গেছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সেক্স লিঙ্ককড প্রচ্ছন্ন জিন মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব সৃষ্টি করে এবং হিমােফিলিয়া, বর্ণান্ধতা, রাতকানা ইত্যাদি রােগ সৃষ্টি করে। নিচের ছকে পরিচিত কয়েকটি প্রচ্ছন্ন সেক্স লিঙ্কড বৈশিষ্ট্যের উদাহরণ ও লক্ষণ দেয়া হলাে-

লাল-সবুজ বর্ণান্ধতা (Red-green color blindness)

মানুষের কোন নির্দিষ্ট বর্ণ দেখার অক্ষমতাকে বর্ণান্ধতা বলে। লাল ও সবুজ রং দেখার অক্ষমতাকে লাল-সবুজ বর্ণান্ধতা বলে।মানুষের চোখের রেটিনায় বর্ণ সংবেদী কোণ কোষ উৎপাদনের জন্য একটি X লিঙ্কড জিন দরকার। মানুষের X ক্রোমােসােমে দুইটি জিন আছে যা চক্ষুর রেটিনায় বর্ণ সংবেদী কোষ গঠনে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। কোণ কোষ তিন ধরনের যাদের প্রত্যেকটি এক একটি বিশেষ রঙের প্রতি সংবেদনশীল।

যেমন- লাল, সবুজ ও নীল। কোণ কোষগুলাে না থাকলে লাল ও সবুজ বর্ণ পৃথকভাবে চেনা যায় না। রং নিয়ন্ত্রণকারী জিনের প্রচ্ছন্ন অ্যালিল উপস্থিত থাকলে বর্ণ সংবেদী কোষ গঠন ব্যাহত হয়। ফলে লাল-সবুজ বর্ণান্ধতা রােগের সৃষ্টি হয়। হােমােজাইগাস নারী (XcXহেটারোজাইগাস পুরুষ (XcY) লাল ও সবুজ বর্ণের সুস্পষ্ট পার্থক্য নির্ণয় করতে পারে না। নারীর ক্ষেত্রে এ জিনটি হােমােজাইগাস প্রচ্ছন্ন না হলে অর্থাৎ ২টি( c)জিন উপস্থিত না থাকলে বর্ণান্ধতা প্রকাশিত হয় না। কিন্তু পুরুষে একটি প্রচ্ছন্ন জিনই সে বৈশিষ্ট্য প্রকাশে সক্ষম।

Leave a Comment