মেন্ডেল এর বংশগতির দ্বিতীয়সূত্র ও এর ব্যাতিক্রম

মেন্ডেল এর বংশগতির দ্বিতীয়সূত্র/স্বাধীন সঞ্চারণ বা ডাইহাইব্রিড ক্রস

‘দুই বা ততােধিক জোড়া বিপরীত বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন জীবে সঙ্করায়ন ঘটালে গ্যামিট সৃষ্টিকালে প্রতিটি বৈশিষ্ট্যের ফ্যাক্টর বা জিন যুগলের স্বাধীন সঞ্চারণ বা বিন্যাস ঘটে এবং কোন একটি ফ্যাক্টর যুগলের সঞ্চারণ অন্য ফ্যাক্টর যুগলের উপর নির্ভরশীল নয়’। একে স্বাধীন সঞ্চারণ বা ডাইহাইব্রিড ক্রস সূত্রও বলে।

ব্যাখ্যা

মেন্ডেলের দ্বিতীয় সূত্র ব্যাখ্যার জন্য একটি ডাইহাইব্রিড ক্রস বর্ণনা করা হলাে।

দুই জোড়া বিপরীত বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন জীবের মধ্যে প্রজননকে ডাইহাইব্রিড ক্রস বলা হয়।

গিনিপিগের কালাে গাত্রবর্ণ সাদা গাত্রবর্ণের উপর প্রকট এবং অমসৃণ লােমের অবস্থা মসৃণের উপর প্রকট। বিশুদ্ধ কালাে-অমসৃণ (black-rough) গিনিপিগের সাথে বিশুদ্ধ সাদা-মসৃণ (white-smooth) গিনিপিগের ক্রস করলে F1 বংশের কালাে-অমসৃণ পুরুষ ও স্ত্রী গিনিপিগের মধ্যে ক্রস করলে F2 বংশে নিম্নলিখিত অনুপাতে গিনিপিগ জন্মলাভ করে। কালাে-অমসৃণঃ কালাে-মসৃণ ও সাদা-অমসৃণ ও সাদা-মসৃণ = ৯ঃ৩ঃ৩ঃ১।

গিনিপিগের কালাে গাত্র বৈশিষ্ট্যের জন্য জিন প্রতীক B এবং অমসৃণ বৈশিষ্ট্যের জন্য জিন প্রতীক R কল্পনা করলে একটি বিশুদ্ধ কালাে-অমসৃণ গিনিপিগের জিনােটাইপ হবে BBRR। কারণ প্রতিটি বৈশিষ্ট্যের জন্য একজোড়া জিন বর্তমান। অনুরূপভাবে সাদা গাত্রবর্ণ বৈশিষ্ট্যের জন্য জিন একক b এবং মসৃণ লােম বৈশিষ্ট্যের জন্য জিন একক r কল্পনা করলে একটি বিশুদ্ধ সাদা-মসৃণ গিনিপিগের জিনােটাইপ হবে bbr /BBRR এবং bbrr পিতা-মাতা গিনিপিগদ্বয় প্রজননের পূর্বে গ্যামিট উৎপাদন করবে এবং প্রত্যেক গ্যামিটে যথাক্রমে BR এবং br জিন থাকবে। ডিম্বাণু ও শুক্রাণুর মিলনে F1 বংশে উৎপন্ন সকল গিনিপিগের জিনােটাইপ হবে BbRr কিন্তু ফিনােটাইপ হবে কালাে-অমসৃণ।

এখানে B এবং R জিনের উপস্থিতিতে যথাক্রমে b এবং r জিন প্রচ্ছন্ন থাকে। F1 বংশের হেটারােজাইগাস কালাে-অমসৃণ (BbRr) গিনিপিগ পুনরায় প্রজননের পূর্বে মায়ােসিসের মাধ্যমে গ্যামিট সৃষ্টি করবে এবং স্ত্রী-পুরুষ প্রত্যেক প্রায় সমান সংখ্যায় চার প্রকার, যথা- BR, Br, bR, br গ্যামিট উৎপন্ন করবে।

এখানে, F1 বংশের দুটি গিনিপিগের মধ্যে ক্রস করলে এদের যেকোনাে এক প্রকার পুংগ্যামিট চার প্রকারের স্ত্রী গ্যামিটের যেকোনাে এক প্রকারের সাথে মিলিত হতে পারে। ফলে F2 বংশে ১৬ প্রকারের নিষেকের সম্ভাবনা থাকে।

জিনতাত্বিক ব্যাখ্যা

মেন্ডেলের ২য় সূত্রের ব্যতিক্রম

পরিপূরক জিন (Complementary Gene)

ভিন্ন ভিন্ন লােকোসে অবস্থিত দুটি প্রকট জিনের উপস্থিতির কারণে যদি জীবের একটি বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পায় তবে সংশ্লিষ্ট জিনদ্বয়কে পরিপূরক জিন বলা হয়।

পরিপূরক জিনের ক্রিয়ার ফলে মেন্ডেলের ২য় সূত্রের ফিনােটাইপিক অনুপাত ৯ঃ৩ঃ৩ঃ১ পরিবর্তিত হয়ে ৯ঃ৭ অনুপাত প্রকাশ পায়। মানুষের মূক-বধিরতা বা ডেফ-মিউটিজম (deaf-mutism) বৈশিষ্ট্য পরিপূরক জিনের ক্রিয়ার ফলে সৃষ্ট।

দৈত্ব প্রচ্ছন্ন এপিস্টেসিস

দুটি প্রচ্ছন্ন জিন একসাথে উপস্থিত থেকে কোন প্রকট জিনের বৈশিষ্ট্য প্রকাশে বাধা দিলে মেন্ডেলের সূত্রের যে ব্যতিক্রম দেখা দেয় তাকে দৈত্ব প্রচ্ছন্ন এপিস্টেসিস বলে।

দৈত্ব প্রচ্ছন্ন এপিস্টেসিস এর কারণে মেন্ডেলের ২য় সূত্রের ফিনোটাইপিক অনুপাত ৯ঃ৩ঃ৩ঃ১পরিবর্তিত হয়ে ৯ঃ৭ অনুপাত প্রকাশ করে। মানুষের মূক-বধিরতা দৈত্ব প্রচ্ছন্ন এপিস্টেসিস এর একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

৯ঃ৭ অনুপাতটির ব্যাখ্যা

যে সব মানুষ কালা/বধির (deaf; কানে শুনেনা) হয় তারা সাধারণত মূক/বােবা (বাকশক্তিহীন; mute)ও হয়। মানুষের এমন অস্বাভাবিকতাকে বলা হয় মূক-বধিরতা (deaf-mutism)।

জিনগত বিশ্লেষণে বুঝা যায় স্বাভাবিক শোনা ও কথা বলার ক্ষমতার জন্য ভিন্ন ভিন্ন দুটি প্রকট জিনের ভূমিকা আছে। এই ভিন্ন ভিন্ন দুটি প্রকট জিনের কার্য পরস্পরের পরিপূরক। অর্থাৎ প্রকট জিন দুটির প্রত্যেকের অন্তত একটি করে জিন না থাকলে মানুষ বােবা-কালা (deaf-mute) হয়। ধরা যাক, স্বাভাবিক অবস্থা অর্থাৎ শ্রবণক্ষমতা ও বাকশক্তির জন্য দায়ী প্রকট জিন দুটি A এবং B। সুত্রানুযায়ী aaBB জিনােটাইপ সম্পন্ন ব্যক্তি মূক-বধির হবে। অনুরূপভাবে, AAbb জিনােটাইপ সম্পন্ন ব্যক্তিও মূক-বধির হবে। উল্লিখিত দুটি জিনােটাইপের দুই জন মূক-বধির স্ত্রী-পুরুষের মধ্যে বিবাহ হলে F1 বংশে সকল সন্তান সন্ততি স্বাভাবিক শ্রবণ ও বাকশক্তি সম্পন্ন হয়।

F1 বংশে প্রাপ্ত দুজন হেটারােজাইগাস স্বাভাবিক শ্রবণ-বাকশক্তি সম্পন্ন স্ত্রী পুরুষের ক্রসে F2 জনুতে ৯ঃ৭ অনুপাত যথাক্রমে স্বাভাবিক শ্রবণ-বাকশক্তি এবং মূক-বধির বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন সন্তান পাওয়া যায়।

জিনতাত্বিক ব্যাখ্যা

এপিস্ট্যাসিস (Epistasis)

সাধারণত প্রকট জিন এর উপস্থিতিতে হেটারােজাইগােটে এর প্রচ্ছন্ন অ্যালিলের বৈশিষ্ট্য অপ্রকাশিত থাকে। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে ক্রোমােসােমের ভিন্ন ভিন্ন লােকাসে অবস্থিত দুটি জিন জীবের একই অঙ্গ বা বৈশিষ্ট্যকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে এবং এক লােকাসে অবস্থিত অন্য একটি জিন এর বৈশিষ্ট্য প্রকাশে বাধা প্রদান করে।

ভিন্ন ভিন্ন লােকাসে অবস্থিত জিন ইন্টারঅ্যাকসনের এ প্রক্রিয়ায় বাধা প্রদানকারী জিনকে এপিস্ট্যাটিক(epistatic) বা বাধক জিন এবং বাধাগ্রন্থ জিনটিকে হাইপােস্ট্যাটিক (hypostatic) জিন বলে।

ভিন্ন ভিন্ন লােকাসে অবস্থিত নন-অ্যালিলিক (non-allelic) জিন যখন অন্য জিনের বৈশিষ্ট্য প্রকাশে বাধাদান করে তখন এ প্রপঞ্চকে (phenomenon) এপিস্ট্যাসিস বলা হয়।

এপিস্ট্যাসিস এর প্রকারভেদ

এপিস্ট্যাসিস প্রকৃতপক্ষে ৪ প্রকার। যথা- প্রকট এপিস্ট্যাসিস, প্রচ্ছন্ন এপিস্ট্যাসিস, ডুপ্লিকেট প্রকট এপিস্ট্যাসিস,ডুপ্লিকেট প্রচ্ছন্ন এপিস্ট্যাসিস।

প্রকট এপিস্ট্যাসিস (Dominant Epistasis)

একই বৈশিষ্ট্য নিয়ন্ত্রণকারী ক্রোমােসােমের এক লােকাসে অবস্থিত কোন প্রকট জিন যদি ক্রোমােসােমের অন্য লােকাসে অবস্থিত অন্য একটি প্রকট জিন এর বৈশিষ্ট্য প্রকাশে বাধা সৃষ্টি করে তা হলে এ প্রক্রিয়াকে প্রকট এপিস্টাসিস বলে। প্রকট এপিস্ট্যাসিসের কারণে মেন্ডেলের ২য় সূত্রের ফিনােটাইপিক অনুপাত ৯ঃ৩ঃ৩ঃ১ পরিবর্তিত হয়ে ১৩ঃ৩ অনুপাতে প্রকাশ পায়।

১৩ঃ৩ অনুপাতের ব্যাখ্যা

সাদা লেগহর্ন (white leghorn) ও সাদা প্লিমাউথ রক (plymouth rock) মােরগ-মুরগীর মধ্যে ১৩ঃ৩ ফিনােটাইপক অনুপাত পাওয়া যায়। সাদা লেগহর্ন মুরগিতে রঙিন পালকের জন্য প্রকট জিন থাকা সত্ত্বেও রঞ্জক পদার্থ উৎপাদনে বাধা প্রদানকারী অন্য একটি প্রকট জিন এর উপস্থিতির জন্য পালকগুলাে সাদা হয়। অপরপক্ষে সাদা প্লিমাউথ রক মুরগীতে রঞ্জক পদার্থ উৎপাদনে বাধা প্রদানকারী কোন প্রকট জিন না থাকা সত্ত্বেও সাদা হয় । একটি সাদা লেগহর্ন মােরগ ও একটি প্লিমাউথ রক মুরগীর মধ্যে ক্রস ঘটালে F1 জনুতে সব সন্তান সাদা পালক বিশিষ্ট হয়।

F1 জনুতে প্রাপ্ত সাদা পালক বিশিষ্ট মোরগ-মুরগির মধ্যে ক্রস করালে F2 জনুতে ৯ঃ৩ঃ৩ঃ১ অনুপাতের পরিবর্তে ১৩ঃ৩ অনুপাতে সাদা ও রঙিন পালক সম্পন্ন মােরগ-মুরগী পাওয়া যায়।

জিনতাত্বিক ব্যাখ্যা

Leave a Comment