মেন্ডেলের বংশগতির প্রথম সূত্র এবং ব্যাতিক্রম

মেন্ডেলের বংশগতির প্রথম সূত্র

‘জীবের প্রতিটি বৈশিষ্ট্য নিয়ন্ত্রণের জন্য একটি একক দায়ী থাকে যাকে ফ্যাক্টর (জিন) বলা হয় এবং ফ্যাক্টর বা জিনগুলাে জোড়ায় জোড়ায় থাকে।

সঙ্কর (hybrid) জীবে ফ্যাক্টর বা জিনগুলাে মিশ্রিত না হয়ে পাশাপাশি অবস্থান করে এবং গ্যামিট উৎপাদনের সময় অপরিবর্তিত অবস্থায় পরস্পর থেকে পৃথক হয়ে ভিন্ন ভিন্ন গ্যামিটে গমন করে। একে পৃথকীকরণ সূত্র বা মনােহাইব্রিড ক্রসের সূত্রও বলে।

ব্যাখ্যা

একটি বিশুদ্ধ কালাে গিনিপিগের সাথে একটি বিশুদ্ধ সাদা গিনিপিগের ক্রস করলে সন্তান-সন্ততি কালাে হয়। আবার F1 সন্তান-সন্ততির মধ্যে ক্রস করলে ৩/৪ ভাগ কালাে গিনিপিগ এবং ১/৪ ভাগ সাদা গিনিপিগের জন্ম হয়। মনেকরি,গিনিপিগের কালাে রঙের জন্য B জিন দায়ী।

অতএব, একটি বিশুদ্ধ বা হােমােজাইগাস কালাে গিনিপিগের জিনােটাইপ BB (কারণ, দেহকোষে কমপক্ষে দুটি ক্রোমােসােম থাকে)। অনুরূপভাবে গিনিপিগের সাদা রঙের জন্য b জিন দায়ী। অতএব, বিশুদ্ধ সাদা গিনিপিগের জিনােটাইপ bb। হােমােজাইগাস কালাে (BB) এবং বিশুদ্ধ হােমােজাইগাস সাদা (bb) পিতা-মাতা (P) প্রজননের পূর্বে গ্যামিট তৈরি করবে। ফলে কালাে গিনিপিগের স্ত্রী-পুরুষ উভয়ের গ্যামিটে B জিন এবং সাদা গিনিপিগের স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষ সকল গ্যামিটে b জিন থাকবে।

এখন উপরিউক্ত কালাে ও সাদা গিনিপিগের ক্রসে B এবং b জিন সম্পন্ন পুং ও স্ত্রী গ্যামিটের মিলনে জিনােটাইপ সম্পন্ন F1 বংশের জন্ম হবে] F1 বংশধরদের মধ্যে B এবং b উভয় অ্যালিল উপস্থিত থাকার কারণে এদের ফিনােটাইপ হবে হেটারােজাইগাস কালাে। এখানে কালাে রঙের জিন B প্রকট এবং সাদা রঙের জিন b প্রচ্ছন্ন। এ জিনদ্বয় হােমােলােগাস ক্রোমােসামের একই লােকাসে অবস্থান করবে। F1 বংশের হেটারােজাইগাস কালাে গিনিপিগ (Bb) পুনরায় প্রজননের জন্য গ্যামিট সৃষ্টি করবে এবং পুরুষ-স্ত্রী প্রত্যেক দুই প্রকার গ্যামিট তৈরি করবে। গ্যামিটের অর্ধেকে থাকবে B জিন এবং বাকি অর্ধেকে থাকবে b জিন।

কারণ সঙ্কর (hybrid)গিনিপিগের B ও b জিন ভিন্ন ভিন্ন ক্রোমােসােমে অবস্থান করে এবং একই কোষে অবস্থান কালে মিশ্রিত হয় না বা বিনষ্ট হয় না। এখন B জিন বহনকারী পুং গ্যামিট B বা b জিন বহনকারী গ্যামিটকে নিষিক্ত করতে পারে। অনুরূপভাবে b জিন বহনকারী পুং গ্যামিট B বা b জিন বহনকারী স্ত্রী গ্যামিটকে নিষিক্ত করতে পারে।

ফলে F2 বংশ 1BB : 2 Bb : 1bb জিনােটাইপিক অনুপাতে যথাক্রমে হােমােজাইগাস কালাে,হেটারােজাইগাস কালাে এবং হােমােজাইগাস সাদা গিনিপিগ জন্মলাভ করে। এদের ফিনােটাইপিক অনুপাত হয় ৩ কালােঃ১ সাদা।

জিনতাত্বিক ব্যাখ্যা

মেন্ডেলের ১ম সূত্রের ব্যতিক্রম সমূহ

মেন্ডেল তার জিনতাত্বিক পরীক্ষার সময় যে সকল বৈশিষ্ট্য নিয়ে কাজ করেছিলেন সেগুলো একটি আরেকটির উপর সম্পূর্ণ প্রকট ছিলো এবং বৈশিষ্ট্য গুলো নিয়ন্ত্রণকারী জিন ভিন্ন ভিন্ন লোকাসে অবস্থান করেছিল। কিন্তু স্বাভাবিক এই নিয়মের ব্যতিক্রম হলে জিনতাত্বিক পরীক্ষা আর মেন্ডেলের সূত্রকে মেনে চলে না। তখন মেন্ডেলের সূত্রের ব্যতিক্রম দেখা যায়। মেন্ডেলের সূত্রের ব্যতিক্রম হলে শুধু ফিনোটাইপিক অনুপাত পরিবর্তন হয় কিন্তু জিনোটাইপিক অনুপাত পরিবর্তিত হয় না।

নিম্নে মেন্ডেলের সূত্রের ৩টি ব্যতিক্রম আলোচনা করা হলো-

১। অসম্পূর্ণ প্রকটতা (Incomplete Dominance)

সংঙ্গা

একজোড়া বিপরীত বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন দুইটি জীবের মধ্যে ক্রস করলে প্যারেন্টের বৈশিষ্ট্যদ্বয়ের কোনােটিই প্রকট বা প্রচ্ছন্ন না হলে ১ম অপত্য বংশে এদের কোনটিই প্রকাশ না পেয়ে উভয় বৈশিষ্ট্যের সংমিশ্রণে একটি ভিন্ন বৈশিষ্ট্য প্রকাশিত হবে। তবে ১ম ও ২য় অপত্য বংশে জিানােটাইপের কোন পরিবর্তন ঘটবে না।

এরূপ প্যারেন্টের বৈশিষ্ট্যদ্বয়ের কোনােটা প্রকট বা প্রচ্ছন্ন না হলে একে অসম্পূর্ণ প্রকটতা বলা হয়। অসম্পূর্ণ প্রকটতার জন্য দায়ী জিনগুলােকে ইন্টারমিডিয়েট জিন বলে।

এই ক্ষেত্রে, এর ফলে শুধুমাত্র ফিনােটাইপেরই পরিবর্তন ঘটবে। অসম্পূর্ণ প্রকটতাকে ইন্টারমিডিয়েট ইনহেরিট্যান্সও বলা হয়।

ব্যাখ্যা

অসম্পূর্ণ প্রকটতার একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলাে গৃহপালিত আন্দালুসিয়ান জাতের মােরগ-মুরগী। কালাে এবং ছােপযুক্ত সাদা পাখির মধ্যে ক্রস করলে F1 অপত্য বংশের পাখি কালাে বা ছােপযুক্ত সাদার কোনটাই না হয়ে সকল পাখি বৈশিষ্ট্যপূর্ণ আন্দালুসিয়ান নীল (blue) রঙের হয়। F1 বংশের এই আন্দালুসিয়ান নীল পাখিদের মধ্যে ক্রসে F2 বংশে কালাে, আন্দালুসিয়ান নীল এবং ছােপযুক্ত সাদা পাখি যথাক্রমে ১ঃ২ঃ১ অনুপাতে পাওয়া যায়।

জিনতাত্বিক ব্যাখ্যা

২।সমপ্রকটতা (Codominance)

সংজ্ঞা

অনেক ক্ষেত্রে হেটারােজাইগাস অবস্থায় কোন অ্যালিল প্রকট না হওয়ার কারণে দুই বা অধিক অ্যালিল সম্পূর্ণ প্রকটতা বা প্রচ্ছন্নতা প্রদর্শন করে না। এ অবস্থায় উভয় অ্যালিল নিয়ন্ত্রিত বৈশিষ্ট্য হেটারােজাইগােটের ফিনােটাইপ সমভাবে প্রকাশিত হয়।

এরূপ জিনকে কোডমিন্যান্ট জিন (Codominat gene) এবং প্রপঞ্চকে সমপ্রকটতা (Codominance) বলা হয়। উদ্ভিদ এবং প্রাণী উভয়ে কোডমিন্যান্স পাওয়া যায়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে হেটারােজাইগােটের ফিনােটাইপ হােমােজাইগাস প্রকট এবং হােমােজাইগাস প্রচ্ছন্নের ইন্টারমিডিয়েট মাঝামাঝি হয়।

ব্যাখ্যা

খাটো শিংওয়ালা জাতের গরুর গাত্রবর্ণ- কোডমিন্যান্সের একটি ক্লাসিক্যাল উদাহরণ হলাে খাটো শিংওয়ালা জাতের গরুর গাত্রবর্ণ। এ জাতের গরুর গাত্রবর্ণ লাল, সাদা ও রােয়ান (roan) হয়ে থাকে।

রােয়ান গরুর নিবিড় পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, প্রতিটি লােম রােয়ান নয়, এদের কিছু লােম সাদা এবং কিছু লােম লাল। এ লাল এবং সাদা রঙের লােমের কম্বিনেসনের সার্বিক ফলাফলে রােয়ান রঙের আবির্ভাব ঘটে। প্রকৃতপক্ষে লাল ও সাদা বর্ণ নির্ধারক অ্যালিলদ্বয় কোডমিন্যান্ট হওয়ার কারণে এদের সংকরায়নে F1 বংশের সকল গরু রােয়ান বর্ণ হয় এবং F2 বংশে ১ঃ২ঃ১ অনুপাতে লাল, রােয়ান এবং সাদা ফিনােটাইপ প্রকাশ পায়।

জিনতাত্বিক ব্যাখ্যা

৩।মারণ জিন বা (Lethal Gene)

হােমােজাইগাস অবস্থায় কোন জিন জীবের মৃত্যুর কারণ হলে সে জিনকে মারণ জিন বা লিথাল জিন বলে। ফরাসি বংশগতিবিদ কুয়েনাে (Cuenot) লিথাল জিন আবিষ্কারক।

ব্যাখ্যা

 দুটি হলুদাভ (yellowish) রঙের ইঁদুরের প্রজননে F1 বংশে ২ঃ১ অনুপাতে যথাক্রমে হলুদাভ এবং হলুদবিহীন রঙের ইঁদুর পাওয়া যায়।

F1 বংশে প্রাপ্ত হলুদাভ দুটি ইদুরের প্রজননে প্রাপ্ত শাবক সংখ্যা, হলুদাভ এবং হলুদবিহীন ইঁদুরের প্রজননে প্রাপ্ত শাবক সংখ্যার তুলনায় প্রায় ১/৪ অংশ কম।ফিনোটাইপিক অনুপাত হয় ২ঃ১। হলুদ রং এর জন্য দায়ী জিন হােমাজাইগাস অবস্থায় থাকলে সে জাইগােট বেঁচে থাকতে পারে না এবং জন্মের পূর্বেই মারা যায়।

জিনতাত্বিক ব্যাখ্যা

Leave a Comment