মানব ভ্রূণের পরিস্ফুটন।ভ্রূণ ও ফিটাসের বিকাশ

মানব ভ্রূণের পরিস্ফুটন

পরিস্ফুটন কি?

নিষেকের পর জাইগােট (Zygote) যে প্রক্রিয়ায় পরিবর্তনের মাধ্যমে পূর্ণাঙ্গ শিশু বা লার্ভায় পরিণত হয় তাকে পরিস্ফুটন বলে।

ব্যক্তিজনিক পরিস্ফুটন

প্রাণিজগৎ এর প্রতিটি সদস্যের পরিস্ফুটন প্রক্রিয়াকে ব্যক্তিজনিক পরিস্ফুটন বলা হয়।

ভ্রূণবিদ্যা

যে শাখায় জীবের ব্যক্তিজনিক পরিস্ফুটন সম্বন্ধে অধ্যয়ন করা হয়, তাকে ভ্রূণবিদ্যা বলে।

এমব্রায়ােজেনেসিস

জাইগােট থেকে ভ্রূণ সৃষ্টির প্রক্রিয়াকে এমব্রায়ােজেনেসিস বলা হয়।

ব্যক্তিজনিক পরিস্ফুটনের ধাপগুলাে নিম্নরূপ-

১। ক্লিভেজ (Cleavage)

যে প্রক্রিয়ায় জাইগােট মাইটোসিস বিভাজনের মাধ্যমে বিভাজিত হয়ে অসংখ্য ভ্রূণকোষ তৈরি করে তাকে ক্লিভেজ বলে। ক্লিভেজে সৃষ্ট ভ্রূণের প্রতিটি কোষকে ব্লাস্টোমিয়ার (blastomere) বলে।

২। মরুলা

ক্লিভেজ প্রক্রিয়ায় ক্রমাগত কোষ বিভাজনের ফলে জাইগােটটি বহুকোষী নিরেট গােলকে পরিণত হয়। এর নাম মরুলা (morula)।

৩।ব্লাস্টুলেশন

মরুলার কোষগুলাে ক্রমশ : এক স্তরে সজ্জিত হয় এবং এর ভেতরে একটি তরলপূর্ণ গহ্বর সৃষ্টি হয়। ভ্রূণের এ দশাকে ব্লাস্টুলা বলে। ব্লাস্টুলার প্রাচীরকে ব্লাস্টোডার্ম এবং তরলপূর্ণ গহ্বরকে ব্লাস্টোসিল বলে। ভ্রূণ ব্লাস্টুলায় পরিণত হওয়ার সাথে সাথে ক্লিভেজ দশার পরিসমাপ্তি ঘটে।

৪। গ্যাস্ট্রুলেশন

ব্লাস্টুলা বিকশিত হয়ে ভ্রূণের পরবর্তী পর্যায় গ্যাস্ট্রলা গঠন করে। যে প্রক্রিয়ার ব্লাস্টুলা থেকে গ্যাস্ট্রুলা গঠিত হয় তাকে গ্যাস্ট্রুলেশন বলে।

গ্যাস্ট্রুলেশন হল প্রাণীর ভ্রূণীয় পরিস্ফুটনের একটি অতি পরিবর্তনশীল ও গতিশীল দশা যাতে ব্লাস্টুলার একস্তরে সজ্জিত কোষগুলাে দুস্তরে সজ্জিত হয়। বাইরের স্তরটি এক্টোডার্ম এবং ভেতরেরটি এন্ডােডার্ম নামে পরিচিত। পরবর্তীতে মােসােডার্ম নামের আরেকটি স্তর গঠিত হয়। ভ্রূণের গ্যাস্ট্রুলা দশায় বিদ্যমান এসব স্তরকে ভ্রূণীয় স্তর বা জার্ম লেয়ার বলে। গ্যাস্ট্রুলার ভেতরের গহবরকে আর্কেন্টেন বলে। এটি একটি ছিদ্র দ্বারা বাইরে উন্মুক্ত হয়। এ ছিদ্রকে ব্লাস্টোপাের বলে।

গ্যাস্ট্রুলেশনের সময় ব্লাস্টুলার কোষসমূহ বা ব্লাস্টোমিয়ারের বিচলনের মাধ্যমে গ্যাস্ট্রুলা গঠিত হয় এবং প্রাণীর নির্দিষ্ট অঙ্গ তথা সামগ্রিক গঠনের রূপরেখা তৈরি হয়।

৫। অর্গানােজেনেসিস

গ্যাস্ট্রুলেশনে সৃষ্ট বিভিন্ন ভ্রূণীয়স্তর থেকে বিভিন্ন অঙ্গ বা তন্ত্র গঠন করার প্রক্রিয়াকে অর্গানােজেনেসিস বলে। প্রথমে ভ্রূণীয় স্তর থেকে ছােট ছােট কোষগুচ্ছ আলাদা হয়ে প্রাথমিক অঙ্গকুঁড়ি সৃষ্টি হয়। পরবর্তীতে অঙ্গকুঁড়ি আরও বিকশিত হয়ে প্রাণীর নির্দিষ্ট অঙ্গ গঠন করে।

ভ্রূণ ও ফিটাসের বিকাশ

জরায়ুতে ভ্রণ সংস্থাপিত হওয়ার পর থেকে গর্ভকালীন ৮ম সপ্তাহের শিশুকে ভ্রূণ এবং এর পর থেকে ভূমিষ্ঠ হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত শিশুকে ফিটাস (fetus) বলে। মায়ের জরায়ুর ভেতরে ভ্রণ ও ফিটাস বিকশিত হয়। মাতৃগর্ভে শিশু প্রায় ৯ মাস বা ৩৬-৩৮ সপ্তাহ থাকে এবং ধারাবাহিকভাবে বিকশিত হয়।

এ সময় যেসব পরিবর্তন ঘটে তার একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেয়া হলাে-

১ম মাস

নিষিক্ত ডিম্বাণু বিভাজিত হয়ে প্রথমে ভ্রূণীয় স্তর এবং পরবর্তীতে প্রাথমিক অঙ্গকুঁড়ি গঠন করে। এসময় ভ্রূণের চারদিকে বিভিন্ন বহিঃভ্রণীয় ঝিল্লী (কুসুম থলি, অ্যামনিওন, অ্যালানটয়েজ ও কোরিয়ন ) সৃষ্টি হয়। শেষের দিকে অমরা, নাভী রঞ্জু, নিউরাল নালি ও দেহখণ্ড বিকাশিত হয়। এসময় দ্রুণ ১/৪সেন্টিমিটার লম্বা হয়। অমরার মাধ্যমে শিশু মাতৃদেহ হতে পুষ্টি গ্রহণ করে এবং নিজ দেহ থেকে বর্জ্য অপসারণ করে।

২য় মাস

মাথার পাশে চামড়া ভাজ খেয়ে কানের সৃষ্টি করে। নিউরাল নালি অধিক বিকশিত হয় । হাত ও পা কুঁড়ির মতাে বিকশিত হয়। ভ্রণ একটি লেজ ও গলায় ফুলকা রন্ধ্র দেখা যায়। এসময় ১ ইঞ্চি লম্বা ও ১/৩০আউন্স ওজনবিশিষ্ট হয়। দ্বিতীয় মাসের শেষের দিকের ভ্রণকে ফিটাস বলে।

৩য় মাস

ফিটাসের হাত ও পায়ের আঙ্গুল পূর্ণ বিকশিত হয় । প্রজনন অঙ্গ গঠিত হয় । তৃতীয় মাসের শেষের দিকে শিশু ৪ ইঞ্চি লম্বা ও ১ আউন্স ওজনবিশিষ্ট হয়।

৪র্থ মাস

শিশুর চোখের পাতা ও ভ্রণ, নখ ও চুল বিকশিত হয়। স্নায়ুতন্ত্র কাজ শুরু করে। হাত ও পায়ের সঞ্চালন শুরু হয়। বৃদ্ধাঙ্গুল চুষতে পারে। এসময় শিশু ৬ ইঞ্চি ও ৪ আউন্স ওজন বিশিষ্ট হয়।

৫ম মাস

শিশুর মাথায় চুল গজায়। শিশুর ত্বক লানুগাে (lanugo) নামক পাতলা ও নরম চুল দ্বারা আবৃত থাকে। পঞ্চম মাসের শেষের দিকে শিশু ১০ ইঞ্চি লম্বা ও ১/২ থেকে ১ পাউন্ড ওজন বিশিষ্ট হয়।

৬ষ্ঠ মাস

শিশুর ত্বক লালচে বর্ণ ধারণ করে, কুঁচকানাে এবং ত্বকে শিরা দৃষ্টিগােচর হয়। ফিঙ্গার প্রিন্ট দেখা যায়। চোখের পাতা খুলতে শুরু করে। এসময় শিশু ১২ ইঞ্চি লম্বা ও ২ পাউন্ড ওজন বিশিষ্ট হয়।

৭ম মাস

শিশুর দেহে চর্বি সঞ্চিত থাকে। শ্রবণ অঙ্গ পূর্ণ বিকশিত হয়। এসময় শিশু প্রায়শই অবস্থান পরিবর্তন করে এবং শব্দ, ব্যথা ও আলাের প্রতি সাড়া দেয়। শিশু ১৪ ইঞ্চি লম্বা ও ২-৪ পাউন্ড ওজনবিশিষ্ট হয়।

৮ম মাস

এসময় শিশুর দেহ দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং শিশু দেখতে শুনতে পারে। ফুসফুস ব্যতীত দেহের সকল অন্তঃঅঙ্গ বিকশিত হয়। এসময় শিশু ১৮ ইঞ্চি লম্বা ও ৫ পাউন্ড ওজনবিশিষ্ট হয়।

৯ম মাস

ফুসফুস পরিপূর্ণভাবে বিকশিত হয়। এসময় প্রতিবর্তি ক্রিয়াসমূহের সমন্বয় ঘটে ফলে শিশু চোখ মিট মিট করা, মাথা ঘুরানাে, আঙ্গুল মুষ্টিবদ্ধ করা এবং শব্দ, আলাে ও স্পর্শের প্রতি সাড়া দেয়া ইত্যাদিতে অভ্যস্ত হয়। এসময় শিশু আকারে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়ে প্রায় ২০ ইঞ্চি লম্বা ও ৭ পাউন্ড ওজন বিশিষ্ট হয় এবং পৃথিবীতে আসার উপযােগী হয়।

Leave a Comment