মানবদেহের রক্ত সংবহনতন্ত্র

রক্ত সংবহনতন্ত্র

মানবদেহের রক্ত সংবহনতন্ত্র প্রধানত: ২ ধরনের।

১. সিস্টেমিক সংবহনতন্ত্র (Systemic circulatory system)
২. পালমােনারি সংবহনতন্ত্র (Pulmonary circulatory system)

সিস্টেমিক সংবহনতন্ত্র

যে সংবহনে রক্ত বাম নিলয় হতে বিভিন্ন রক্ত কণিকার মাধ্যমে অঙ্গগুলােতে পৌঁছায় এবং অঙ্গগুলাে থেকে ডান অলিন্দে ফিরে আসে তাকে সিস্টেমিক সংবহন (Systemic circulation) বলে।

সিস্টেমিক ধমনির উদ্ভব হয় অ্যাওটা থেকে, আর অ্যাওটার উদ্ভব ঘটে বাম নিলয় থেকে। হৃদপিণ্ডের সংকোচনের ফলে রক্ত বাম নিলয় থেকে প্রথমে অ্যাওটার ভেতর দিয়ে ধমনিতে প্রবেশ করে পরে দেহের বিভিন্ন অঙ্গের ধমনি ও জালিকার ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়। জালিকা থেকে পুনরায় রক্ত সংগৃহীত হয়ে উপশিরার মাধ্যমে শিরায় প্রবেশ করে। শিরার রক্ত পরে সুপিরিয়র ভেনাক্যাভা ও ইনফিরিয়ার ভেনাক্যাভা দিয়ে হৃদপিন্ডের ডান অ্যাট্রিয়ামে প্রবেশ করে।

এই সিস্টেমিক সংবহনতন্ত্র প্রধানত: দুই ভাগে বিভক্ত। যথা: (ক) সিস্টেমিক ধমনিতন্ত্র (খ) সিস্টেমিক শিরাতন্ত্র।

(ক) সিস্টেমিক ধমনিতন্ত্র

বাম নিলয়ের অগ্রভাগ থেকে উৎপন্ন হয়ে অ্যাওটায় এ তন্ত্রের সূচনা করে, সম্মুখ দিয়ে স্বল্প দূরত্ব অতিক্রম করেই বাম দিকে বাঁকা হয়ে অ্যাওর্টিক আর্চ গঠন করে। অ্যাওর্টিক আর্চটি অতঃপর পশ্চাতে বাঁ দিক বরাবর এসে এককভাবে ডর্সাল অ্যাওটা গঠন করে।

করােনারি ধমনি (Coronary artery)

অ্যাওটা অ্যাওর্টিক আর্চ গঠনের পূর্বেই ডান ও বাম করােনারি ধমনি উৎপন্ন করে। এরা অক্সিজেন যুক্ত রক্ত হৃদপেশীতে সরবরাহ করে।

অ্যাওর্টিক আর্চ ও ডাল আওটা থেকে সৃষ্ট ধমনিগুলাে বিভিন্ন শাখার মাধ্যমে সারা দেহে রক্ত সরবরাহ করে। শাখাগুলাে নিম্নরূপ-
ইনমিনেট ধমনিঃ এটি একটি খাটো ও মােটা ধমনি। এটি অভিন্ন ক্যারােটিড ধমনি ও ডান সাবক্লেভিয়ান ধমনিতে বিভক্ত।
আন্তঃক্যারােটিড ধমনিঃ করাের্টি গহ্বরে প্রবেশ করে সম্মুখ সেরেব্রাল ও মধ্য সেরেব্রাল ধমনিতে বিভক্ত হয়ে মস্তিষ্কে রক্ত সরবরাহ করে।
বহি: ক্যারােটিড ধমনিঃ মাথার ত্বক এবং ঘাড়ে রক্ত সরবরাহ করে।

অফথ্যালমিক (Opthalmic)

ধমনি অক্ষিকোটরে প্রবেশ করে অক্ষিগােলক, ল্যাক্সিমাল গ্রন্থি ও কপালের পেশি ও ত্বকে শাখা প্রেরণ করে। বহিঃক্যারােটিড ধমনি এখান থেকে উৎপন্ন শাখাগুলাে-

• সুপিরিয়র থাইরয়েড ধমনি: থাইরয়েড গ্রন্থি ও ল্যারিংক্সে রক্ত বহন করে।
• লিঙ্গুয়াল ধমনি: জিহ্বা ও সাবলিঙ্গুয়াল গ্রন্থিতে রক্ত বহন করে।
ফেসিয়াল ধমনি: মুখমণ্ডল, চোখ, সাব-ম্যাক্সিলারি গ্রন্থি এবং মুখমণ্ডলের ত্বক ও পেশিতে রক্ত সরবরাহ করে।
অক্সিপিটাল ধমনি: অক্সিপিটাল অঞ্চলের ত্বক ও পেশিতে রক্ত বহন করে ।
• ফ্যারিঞ্জিয়াল ধমনি: গলবিলে রক্ত বহন করে।এছাড়া বহিঃক্যারােটিড ধমনি আন্তঃম্যাক্সিলারি ও সুপারফিসিয়াল টেমপােরাল ধমনিতে বিভক্ত হয়।
• আন্তঃম্যাক্সিলারি ধমনি: চোয়াল, দাঁত, চর্বনপেশী, নাসাপ্রাচির, তালু, স্যুরা ম্যাটারে রক্ত বহন করে।
সুপারফিসিয়াল ধমনি: টেমপােরাল অঞ্চলে রক্ত বহন করে।

সাবক্লেভিয়াল ধমনিঃ
দেহের প্রতিপাশে ফুসফুসের উপর দিয়ে বিভিন্ন শাখায় বিভক্ত হয়ে বিভিন্ন অঙ্গে রক্ত বহন করে।যেমন-আন্তঃম্যামারি ধমনি: স্তনগ্রন্থি, বক্ষীয় প্রাচীর ও পেরিকার্ডিয়ামে রক্ত বহন করে।
• থাইরােসার্ভিকাল ধমনি: থাইরয়েড গ্রন্থি, ল্যারিংক্স ও ঘাড়ের পেশিতে রক্ত বহন করে।
• সার্ভিকাল ধমনি: অক্সিপুটের পেশিতে রক্ত বহন করে।
• ভার্টিব্রাল ধমনি: মেরুদণ্ডের রক্ত সরবরাহ করে।
• সিলিয়াক ধমনি: পাকস্থলী ও যকৃতে রক্ত সরবরাহ করে।

ফ্রেনিক ধমনি: ডায়াফ্রামে রক্ত সরবরাহ করে।
বৃক্কীয় ধমনি: বৃক্কে রক্ত সরবরাহ করে।
মেসেন্টেরিক ধমনি: অন্ত্রের বিভিন্ন অংশে রক্ত সরবরাহ করে।
জনন ধমনি: গােনাডে রক্ত সরবরাহ করে।
• ইলিয়াক ধমনি: পেলভিস অঞ্চল, উরু, পা ইত্যাদি অংশে রক্ত সরবরাহ করে।

খ. সিস্টেমিক শিরাতন্ত্র (Systemic venous system)

যে শিরাতন্ত্র দেহের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে রক্ত সংগ্রহে প্রধান ভূমিকা পালন করে তাকে সিস্টেমিক শিরাতন্ত্র বলে । শিরাতন্ত্রটি প্রধানত: দুটি প্রধান শিরা নিয়ে গঠিত। যথা-

ব্র্যাকিওসেফালিক শিরা: মেরুদণ্ড, মস্তিষ্ক থেকে ভাটিব্রাল শিরা, উধ্ববাহু বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ব্র্যাকিয়াল শিরা এবং ডায়াফ্রাম, স্তন গ্রন্থি থেকে অন্তঃস্থ ম্যামারি শিরা মিলিত হয়ে এ শিরা গঠিত হয়।

সেফালিক শিরা: হাতের পৃষ্ঠদেশ থেকে উঠে সম্মুখ বাহু ও উর্ধ্ববাহুর ব্র্যাকিয়াল শিরায় রক্ত বহন করে।

সাভক্রেভিয়ান শিরা: বাহু, শ্রোণিচক্র, গ্রীবা প্রভৃতি অঞ্চল থেকে রক্ত সংগ্রহ করে।

অন্তঃস্থ জুগুলার শিরা: গলার প্রতিপাশ থেকে উপরে উঠে নিজ নিজ অংশের মাথা, মুখমণ্ডল ও গ্রীবা থেকে রক্ত সংগ্রহ করে।

ইনফিরিয়র ভেনাক্যাভা: এটি উদরীয় গহ্বরে অ্যাওটার ডান পাশে অবস্থিত। এটি ডায়াফ্রামের একটি ছিদ্র পথে বক্ষীয়
গহ্বরে প্রবেশ করে এবং রক্তকে ডান অ্যাট্রিয়ামে বহন করে। ইনফিরিয়র ভেনাক্যাভা দুটি (ডান ও বাম) অভিন্ন ইলিয়াক শিরা নিয়ে গঠিত। প্রতিটি ইলিয়াক শিরা আবার অন্তঃস্থ ও বহি:ইলিয়াক শিরা দ্বারা গঠিত। অন্তঃস্থ ইলিয়াক শ্রোণি অঞ্চল, মলাশয়, জরায়ু প্রভৃতি থেকে ও বহিঃস্থ ইলিয়াক পায়ের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সাফেনাপাভা, টিবিয়াল, পপলিশিয়াল, সাফেনাম্যাগনা ও ফিমােরাল শিরার মাধ্যমে রক্ত সংগ্রহ করে এবং পরিশেষে ইনফিরিয়র ভেনাক্যাভা গঠন করে, দেহের নিম্নাংশ থেকে শিরা রক্ত বহন করে হৃদপিন্ডে পৌঁছে দেয়।

পালমােনারি সংবহনতন্ত্র (Pulmonary circulatory system)

এটি পালমােনারি ধমনি ও পালমােনারি শিরা নিয়ে গঠিত। ডান নিলয়ের উপরি ভাগ থেকে উৎপন্ন পালমােনারি মহাধমনি দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পালমােনারি ধমনি গঠন করে। এরা ডান নিলয় থেকে অক্সিজেন রক্ত (CO, সমৃদ্ধ) ফুসফুসে পরিবহন করে। ফুসফুসের পালমােনারি ধমনি থেকে উৎপন্ন ক্যাপিলারি জালকগুলাে পরস্পর মিলিত হয়ে পালমােনারী শিরা গঠন করে। এ শিরার মাধ্যমে অক্সিজেনযুক্ত রক্ত ফুসফুস থেকে বাম অলিন্দে পরিবাহিত হয়

করােনারি রক্ত সংহবনতন্ত্র (Coronary circulation)

দেহে বিভিন্ন পদার্থ পরিবহনের অন্যতম মাধ্যম রক্ত। যার মাধ্যমে প্রয়ােজনীয় রাসায়নিক পদার্থ বিভিন্ন কোষ কলায় পৌঁছে এবং বিপাকীয় পদার্থ রেচনের জন্য নির্দিষ্ট অঙ্গে বাহিত হয়। তবে দেহে রক্ত সংবহনের চালিকাশক্তি হিসেবে যে অঙ্গটি সমগ্র দেহের প্রতিটি কোষে অক্সিজেন ও পুষ্টি সরবরাহ করে সেটি হচ্ছে হৃদপিণ্ড। হৃদপিণ্ডের নিজের জন্যও অক্সিজেন ও পুষ্টির প্রয়ােজন। এ চাহিদা পূরণ হয় করােনারি সংবহনের মাধ্যমে পরিবাহিত রক্ত দিয়ে। হৃদপিন্ডের এই বিশেষ সংবহনকে করােনারি রক্ত সংবহন বলে।

Leave a Comment