বিবর্তন (Evolution)

এই পাঠে যা রয়েছে-
  1. বিবর্তন (Evolution)
  2. জৈব বিবর্তন
  3. বিবর্তন এর মতবাদসমূহ (The theories of evolution)
  4. ২. ডারউইনিজম (Darwinism)
  5. ডারউইন-ওয়ালেস তত্ত্বের প্রতিপাদ্য বিষয়গুলাে নিম্নে সংক্ষেপে আলােচনা করা হলাে-

বিবর্তন (Evolution)

বিবর্তনের অপর নাম অভিব্যক্তি। বিবর্তন বলতে সাধারণভাবে বুঝায় কোনাে কিছু বিকশিত হওয়া, ধীরে ধীরে উন্মোচিত হওয়া। বিশাল পৃথিবীর বুকে বর্তমানে বিভিন্ন প্রকারের যে সকল উদ্ভিদ ও প্রাণীর সমারােহ দেখা যায় তারা ইতিপূর্বে বিদ্যমান সরল প্রকৃতির জীব থেকে ক্রমপরিবর্তনের মাধ্যমে উদ্ভূত হয়েছে- এ ধারণাকে জৈব বিবর্তনবাদ (the theory of organic evolution) বলে ।

আধুনিক বিজ্ঞানীদের ধারণা অনুযায়ী প্রায় ৪৫০ কোটি বৎসর পূর্বে সূর্যের বিচ্ছিন্ন অংশ হতে পৃথিবীর উদ্ভব ঘটে। উৎপত্তির প্রথম অবস্থায় এটি একটি জ্বলন্ত অগ্নিপিণ্ড বিশেষ ছিল এবং তাপ বিকিরণের ফলে ধীরে ধীরে শীতল হয় এবং জলীয় বাষ্প হতে ঘন মেঘের সৃষ্টি হয়। মেঘ হতে বৃষ্টিপাতের ফলে কালক্রমে জলভাগগুলাের সৃষ্টি হয়।

মেঘাচ্ছন্ন এই অবস্থায় হঠাৎ সূর্যের আলাে পেয়ে পানিতে বিদ্যমান অক্সিজেন, হাইড্রোজেন ইত্যাদি মৌলিক উপাদান সংমিশ্রিত হয়ে আকস্মিকভাবে প্রােটোপ্লাজমের উদ্ভব হয়। আবহাওয়ার পরিবর্তনের পরবর্তী বছরে পরিবেশের আরও পরিবর্তনের ফলে কালক্রমে এই প্রােটোপ্লাজম হতে প্রথমে এককোষী উদ্ভিদ ও পরে কতকগুলাে উদ্ভিদের দেহ হতে মিউটেশন (mutation) এর ফলে ক্লোরােফিল বিনষ্ট হয়ে প্রাণীর উদ্ভব হয়।

ক্রমান্বয়ে এককোষী উদ্ভিদ ও প্রাণী বহুকোষী উদ্ভিদ ও প্রাণীতে পরিণত হয় এবং এদের ক্রমবিকাশের ফলে বিভিন্ন প্রকারের উদ্ভিদ ও প্রাণীর উদ্ভব হয়।

জৈব বিবর্তন

পূর্ব থেকে বিদ্যমান একটি সরল জীব পরিবেশের সাথে অনুকূলতা রক্ষাকরে ধীরগতিতে সার্বক্ষণিকভাবে দৈহিক পরিবর্তন আনয়নের মাধ্যমে নতুন জীবে রূপান্তরিত হওয়াকে জৈব বিবর্তন (organic evolution) বলে।

বিবর্তন এর মতবাদসমূহ (The theories of evolution)

বিবর্তন ঘটছে- এটি প্রমাণ করা সম্ভব হলেও, কিভাবে ঘটছে। এই ব্যাপারে মতভেদ আছে। বিবর্তনের প্রক্রিয়া সম্পর্কিত বিবর্তনবিদ গণের ব্যাখ্যাসমূহকেই বিবর্তনের মতবাদ (the theories of organic evolution) বলে। বিবর্তনের মতবাদগুলাের মধ্যে উল্লেখ্যযােগ্য হলাে- ১. ল্যামাৰ্কিজম, ২.ডারউইনিজম ও ৩, নব্য ডারউইনিজম।

১. ল্যামার্কিজম (Lamarckism)

ফরাসী প্রকৃতি বিজ্ঞানী Jcan Baptist Lamarck (১৭৪৪-১৮২৯), ১৮০৯ খ্রিস্টাব্দে ফিলােসফিক জুলজিক (Philosophic Zoologique) গ্রন্থে অর্জিত বৈশিষ্ট্যের বংশগতি (theory of inheritance of acquired character) নামক বিবর্তন সম্পর্কীত মতবাদ প্রকাশ করেন।

ল্যামার্কের মতবাদের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হলাে, পরিবেশের প্রভাবের ফলেই বিবর্তন সংঘটিত হতে পারে। পরিবেশের প্রভাবে জীবের দৈহিক গঠনের পরিবর্তন হয়। তাঁর মতে বিবর্তন কতিপয় রীতি-নীতি মেনে চলে। এই রীতি-নীতিগুলােই বিবর্তনের ক্রম ও বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ করে। ল্যামার্ক তাঁর বিবর্তন তত্ত্বেও এ রীতি-নীতিগুলােই ব্যাখ্যা করেছেন।

আধুনিক বিজ্ঞানীদের মধ্যে Dodson, 1960 ল্যামার্কের একজন বিশিষ্ট সমর্থক। Dodson ল্যামার্কাদকে চারটি সূত্রে ব্যাখ্যা করেছেন যা ল্যামাকীয় সুত্র বলেও পরিচিত।

ল্যামার্কের সূত্র

সূত্র ১

জীবদেহ এবং দেহের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ আকারে ক্রমবর্ধিত হওয়ার একটি লক্ষণ সর্বদাই পরিলক্ষিত হয়।

সূত্র ২

জীবন ধারণের প্রয়ােজনে কোন নতুন চাহিদা এবং এ চাহিদার ফলে জীবন অভ্যাসের যে পরিবর্তন হয় তার ফলেই নতুন প্রত্যঙ্গের উৎপত্তি হয়।

সূত্র ৩

কোন একটি অঙ্গ প্রতিনিয়ত ব্যবহৃত হলে তা উন্নত এবং সুগঠিত হয়, কিন্তু ব্যবহৃত না হলে ক্রমান্বয়ে ক্ষয়প্রাপ্ত হতে হতে অবশেষে বিলুপ্ত হয়ে যায়। এ সুত্রটি ব্যবহার ও অব্যবহারের সূত্র নামে পরিচিত।

সূত্র ৪

কোন একটি জীবের দেহে উন্নতি বা ক্ষয়প্রাপ্তির মাধ্যমে যে সকল পরিবর্তন সাধিত হয় তা অর্জিত বৈশিষ্ট্যরূপে অঙ্গীভূত হয় এবং পরবর্তী প্রজন্মে (Generation) সঞ্চারিত ও বিকশিত হয়। এ সূত্রটি অর্জিত বৈশিষ্ট্য সঞ্চারণের সূত্র(Law of inhertance of acquired character) নামে পরিচিত।

ল্যামার্কবাদের স্বপক্ষে প্রমাণ

কোনাে জীবের দেহে পরিবেশের প্রভাবে বা প্রাকৃতিক অভিঘাতের ফলে যে রূপান্তর সংঘটিত হয় তাহা প্রজন্ম হতে প্রজন্ম বংশানুক্রমে সঞ্চারিত ও বিকশিত হয়ে নতুন প্রত্যঙ্গে পরিণত হয়।

বিভিন্ন আলােচনা ও সমালােচনা হইতে প্রতীয়মান হয় যে, ল্যামার্কের দ্বিতীয় ও তৃতীয় সূত্রে কিছুটা সত্য নিহিত আছে। উদাহরণস্বরূপ, অব্যবহারজনিত বিলুপ্তির উদাহরণ পাওয়া যায় সাপের উপাঙ্গে যা গর্তে প্রবেশের সময় ভূমির সাথে ঘর্ষণ এবং দীর্ঘ দিনের অব্যবহারের ফলে কালক্রমে বিলুপ্ত হয়েছে। উট পাখির পূর্ব পুরুষেরা উড়তে পারতাে কিন্তু বংশানুক্রমে দীর্ঘদিন ডানা ব্যবহার না করার ফলে তা নিষ্ক্রিয় অঙ্গে পরিণত হয়েছে।

প্রতিনিয়ত ব্যবহারের ফলে অঙ্গ উন্নত ও সুগঠিত হয়। যেমন- কর্মকার, ব্যায়ামবিদ, দৌড়বিদ প্রভৃতি মানুষের পেশি খুব সুগঠিত। ল্যামার্ক মনে করেন যে, প্রাচীনকালে জিরাফের সামনের পা ও গ্রীবা লম্বা ছিল না। পরবর্তী কালে ব্যবহারিক প্রয়ােজনে জিরাফের পা ও গ্রীবা প্রলম্বিত হয়েছে। স্থলভাগে চারণযােগ্য ভূমির অভাব অনুভূত হওয়ায় জিরাফের হরিণাকৃতি পূর্ব পুরুষেরা গাছের পাতা ভক্ষণ করতে আরম্ভ করে। এর জন্য তাদের সামনের পায়ে ভর দিতে এবং গ্রীবা উত্তোলন করতে হতাে।

ক্রমান্বয়ে বৃক্ষ শীর্ষস্থিত পাতাগুলাে ভক্ষণের জন্য অগ্র পায়ের অধিক ব্যবহার এবং গ্রীবা উত্তোলন ও প্রসারণের ফলে বংশানুক্রমে প্রলম্বিত হতে হতে এরা বর্তমান রূপ ধারণ করেছে।

২. ডারউইনিজম (Darwinism)

ইংরেজ প্রকৃতিবিদ চার্লস রবার্ট ডরইউন (১৮০৯-১৮২২) ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দে পৃথিবী প্রদক্ষিণরত HMS Beagle জাহাজে প্রকৃতিবিদের অবৈতনিক চাকরি নিয়ে কেপ, ডান্ডি, আটলান্টিক দ্বীপপুঞ্জ, তাহিতি,নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, তাসমানিয়া মালদ্বীপ, মরিসাস, সেন্ট হেলেনা, ব্রাজিল, গ্যালাপ্যাগােস দ্বীপপুঞ্জ প্রভৃতি স্থানে পাঁচ বছর (২৭ ডিসেম্বর ১৮৩১ থেকে ২ অক্টোবর ১৮৩৬) কালব্যাপী ভ্রমণ শেষে জৈব বিবর্তন এবং প্রাণীসমূহের ভেতর সাদৃশ্য ও সম্পর্ক বিষয়ে বিভিন্ন উপাত্ত সংগ্রহ করেন।

পরবর্তী প্রায় ১৫ বছর তিনি এসব উপাত্ত নিয়ে গবেষণা করেন। এ সময়েই ম্যালথাস এর জনসংখ্যা সম্পর্কীত প্রবন্ধ পাঠ করে প্রাকৃতিক সংঘাত কিভাবে প্রাণীসমূহের স্থায়িত্বকে নিয়ন্ত্রণ করে তিনি সে সম্বন্ধে অবহিত হন। এরই এক পর্যায়ে ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে আলফ্রেড রাসেল ওয়ালেস (১৮২৩-১৯১৩) ডারইউন এর সাথে অভিন্ন মত প্রকাশ করেন।

অতঃপর জিওলজিস্ট লায়েল ও উদ্ভিদবিদ হুকার বন্ধুদ্বয়ের পরামর্শ অনুযায়ী ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে ১লা জুলাই প্রাকৃতিক নির্বাচন দ্বারা প্রজাতির উৎপত্তি নামক মতবাদটি লন্ডনের লিনিয়ান সােসাইটির সভায় প্রকাশ করেন। ডারউইনের তত্ত্ব বা ডারউইন ওয়ালেস তত্ত্ব প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্ব নামে পরিচিত।

জুলিয়ান হাক্সলে এর মতে এই তত্ত্ব তিনটি পর্যবেক্ষণ ও দুইটি সিদ্ধান্তের উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত। ওয়ালেস এর ব্যাখ্যানুসারে এ তত্ত্ব ও সিদ্ধান্তগুলাে

নিম্নরূপ-

পর্যবেক্ষণ ১

পর্যবেক্ষণ ২

ডারউইন-ওয়ালেস তত্ত্বের প্রতিপাদ্য বিষয়গুলাে নিম্নে সংক্ষেপে আলােচনা করা হলাে-

১। অত্যধিক বংশ বৃদ্ধির হার (Prodigality of production)

প্রত্যেক জীবে জ্যামিতিক হারে বংশ বৃদ্ধির একটা প্রবণতা দেখা যায়।

এককোষী জীব প্যারামেসিয়াম বছরে প্রায় ৬০০ বার জনন কার্য সম্পন্ন করে। এই ক্ষুদ্র প্যারামেসিয়াম এর সকল বংশধর বেঁচে থাকলে পৃথিবী ভরে যেত। ডারউইন হিসাব করে দেখিয়েছেন যে, প্রতি জোড়া হাতি দম্পতি যারা ৯০ বৎসরের জীবনকালে একটি করে মাত্র ৬ বার বাচ্চা দেয়, যদি সবগুলাে বাচ্চা বেঁচে থাকতাে এবং প্রতিটি স্ত্রী শাবক বেঁচে থেকে অনুরূপভাবে বংশ বৃদ্ধি করতাে তবে ৭৫০ বছরে প্রায় ১ কোটি ৯০ লক্ষ হাতি হতাে।

কিন্তু তা হয়না। প্রজাতির সংখ্যা মােটামুটি অপরিবর্তিত থাকে।

২। স্থান ও খাদ্যের সীমাবদ্ধতা (Limitation of Food and Space)

যে হারে জীব উৎপন্ন হয় সে অনুপাতে পৃথিবীতে স্থান ও খাদ্য নেই। এ অবস্থায় ধারণ ক্ষমতার অতিরিক্ত জীব উৎখাত করতে একাধিক প্রভাব বিজড়িত হয়ে পড়ে।

৩। জীবন ধারণের জন্য সংগ্রাম (struggle for existence)

ধারণ ক্ষমতার চেয়ে বেশি জীব উৎপন্ন হওয়ায় অস্তিত্ব বজায় রাখার নিমিত্তে খাদ্য, স্থান প্রভৃতির জন্য সংগ্রাম অনিবার্য হয়ে উঠে। এ সংগ্রাম তিন ধরনের। যথা-

ক.অন্ত:প্রজাতিক সংগ্রাম (Intraspecific struggle)

একই প্রজাতির জীবের মধ্যে খাদ্য, আশ্রয়, প্রজনন, ভূমি ইত্যাদির জন্য সংগ্রামকেই অন্তঃপ্রজাতিক সংগ্রাম বলে।

খ. আন্তঃপ্রজাতিক সংগ্রাম (Interspecific struggle)

ভিন্ন ভিন্ন প্রজাতির জীবের মধ্যে সংগ্রামকে বুঝায়। এই সংগ্রামে সম্পর্কটি সাধারণত খাদ্য ও খাদকের মধ্যে বিরাজমান।

গ. পরিবেশগত সংগ্রাম(Environmental stuggle)

জীবের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য পরিবেশের সাথে (যেমন- খরা, প্লাবন, শীত, ঝড়, বৃষ্টি প্রভৃতি) সংগ্রামকে বুঝায়।

৪। প্রকরণ (Variation)

পৃথিবীতে কোন দুইটি জীব হুবহু একরূপ নয়। একই প্রজাতির জীবের মধ্যে, এমনকি একই পিতা-মাতার সন্তান-সন্ততির মধ্যে প্রকরণ বা ভেদ দেখা যায়। প্রজননের মাধ্যমে এই প্রকরণ সন্তান-সন্ততিতে সঞ্চারিত হয়। অর্থাৎ সংগ্রামের ফলে অভিযােজনজাত প্রকরণ বংশানুক্রমে পরিচালিত হয়ে অবশেষে জীবের বৈশিষ্ট্যরূপে প্রতিষ্ঠা লাভ করে।

ডারউইনের মতে সামান্য ধারাবাহিক প্রকরণই ভিন্ন ভিন্ন জীব উৎপত্তির জন্য দায়ী।

৫। প্রাকৃতিক নির্বাচন বা যােগ্যতমের উর্দ্ধতন (Natural Selection or Survival of the Fittest)

ডারউইনের মতে জীবন ধারণের সংগ্রামে কেবল সেই জীব সাফল্য লাভ করে যাদের দেহে সংগ্রামের পক্ষে অনুকূলে এবং অধিকতর ও সঙ্গত সামঞ্জস্যপূর্ণ অভিযােজন বা প্রকরণ থাকে।

যে সকল জীবের অভিযােজন বা প্রকরণ সংগ্রাম উত্তরণের উপযােগী নহে তারা পৃথিবী হতে বিলীন হয়ে যায়। ডারউইন একে প্রাকৃতিক নির্বাচন (natural selection) বলে অভিহিত করেছেন। Herbert Spencer একে যােগ্যতমের উদ্ধর্তন (survival of the fittest) হিসেবে অ্যাখায়িত করেছেন।

৬। উত্তরলব্ধি ও নতুন প্রজাতির উৎপত্তি (Inheritance and Origin of New Species)

সুবিধাজনক প্রকরণসমূহ প্রাকৃতিক নির্বাচনে উৰ্ত্তীণ হয়ে তারা সন্তান-সন্ততিতে সঞ্চারিত হয়। সন্তান-সন্ততির আরাে প্রকরণের ফলে জনু থেকে জনুতে ক্রমান্বয়ে জীবের বৈশিষ্ট্যের রূপান্তর ঘটে। এভাবে অনেক জনুর পর সামান্য প্রকরণগুলাে সঞ্চিত ও প্রতিষ্ঠিত হয়ে নতুন বৈশিষ্ট্যরূপে দেখা যায়। ফলে নতুন প্রজাতির উদ্ভব হয়।

Leave a Comment