নব্য-ডারউইনবাদ।আর্কিওপটেরিক্স

নব্য-ডারউইনবাদ (Neo-Dawinism)

নব্য-ডারউইনবাদ বস্তুত ডারউইনবাদের আধুনিক রূপরেখা (modern systhesis)। বলা যায় মেন্ডেলিয় জেনেটিক্স এর সাথে প্রাকৃতিক নির্বাচন এর নতুন সংশ্লেষ, প্রাক-মেন্ডেলিয় যুগে যা ছিল একটি মিশ্র প্রক্রিয়া। ডারউইন তাঁর বিখ্যাত প্রাকৃতিক নির্বাচন মতবাদের নতুন প্রজাতির উৎপত্তি বিষয়ে যে ব্যাখা দেন তা যথেষ্ট মনে হয়নি বরং এ ব্যাখ্যা নিয়ে ডারউইন সমালােচনার মুখে পড়েন।

অনেক বিজ্ঞানী মনে করেন, প্রাকৃতিক নির্বাচন ক্রিয়াশীল সন্দেহ নেই কিন্তু কিভাবে নতুন বৈশিষ্ট্য বা নতুন প্রজাতির উদ্ভব হয় ডারউইনবাদে তার উত্তর নেই। এর জন্য অবশ্য ডারউইনকে দায়ী করা যায় না। কারণ, জীবের প্রকরণ (variation) কিভাবে হয় ডারউইন যুগে সে তথ্য জানা ছিল না।

মেন্ডেলিয়ান জেনেটিক্স প্রবর্তনের ফলে জানা যায়, জীবের বংশগত বৈশিষ্ট্যের আকস্মিক বংশাণুসৃতিযােগ্য পরিবর্তন বা পরিব্যক্তি (mutation) ই হলাে নতুন প্রজাতি সৃষ্টির কাঁচামাল যা এখন স্বতঃসিদ্ধ বলে পরিগণিত। তাই ডারউইনের এই সমস্যাকে নিয়ে জর্জ রােমানেস (Geogre Romanes) নব্য ডারউইনবাদ নামকরণ করেন। জীবের বংশাণুসৃতিযােগ্য পরিবর্তনের মূল কেন্দ্রবিন্দু হলাে জীবকোষের মধ্যস্থিত ডিএনএ অণু (DNA molecule)।

অবশ্য বেশ আগেই বিজ্ঞানীরা এই ম্যাজিক অণুটির সম্পর্কে ধারণা পেয়ে যান। জানা যায় যে, DNA হলাে বংশগত বৈশিষ্ট্যের মূল আধার। DNA বংশানুক্রমে জীবদেহে সঞ্চারিত হতে হতে মাঝে মাঝে ভূল মুদ্রণ (mis-copying) করে ফেলে যার জন্য সৃষ্টি হয় পরিব্যক্তি (mutation) এবং জন্ম নেয় নতুন জিন এবং নতুন প্রজাতি। বস্তুত এটিই হচ্ছে প্রজাতির উৎপত্তি (origin of species) এর ধারণা।

অগাস্ট ভাইজম্যান (August Weismann) এর নেতৃত্বে একদল বিজ্ঞানী ডারউনের প্রাকৃতিক নির্বাচন মতবাদকে নতুন মাত্রা দিয়ে নব্য-ডারউইনবাদকে এগিয়ে নেন। নব্য-ডারউইনবাদের মতে যে প্রক্রিয়ায় ক্ষুদ্র পরিবর্তনগুলাে(microevolution) ঘটে, সেই একই প্রক্রিয়ায় বৃহৎ পরিবর্তনগুলােও ঘটে। এখানে বলা হয় বিবর্তন একটি দৈব প্রক্রিয়া যা দৈবাৎ ঘটনা।

আকস্মিকভাবে DNA – এর এক বা একাধিক নিউক্লিওটাইড এর মধ্যে পরিবর্তন দ্বারা ছােট বা বড় পরিবর্তন (macroevolution) এর সৃষ্টি হয়। বড় পরিবর্তন ঘটে রিকম্বিনেসন বা জেনেটিক সংমিশ্রণের কারণে। এই দুই প্রক্রিয়ামিউটেসন এবং রিকম্বিনেসন এর যুগপৎ সংমিশ্রণের নতুন বৈশিষ্ট্যের উদ্ভব হয় এবং নতুন প্রজাতির সৃষ্টি হয়।

বিবর্তনের কৌশলগত ব্যাখ্যাকে চূড়ান্ত রূপ দেন হাক্সলে, ফিশার, ডবজানস্কি, রাইট, মায়ার, সিম্পসন ও স্টেবিনস। এদের গবেষণা লব্ধ তত্ত্ব এবং তথ্য বর্তমানে মিশ্র তত্ত্ব (synthetic theory) নামে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে নব্য-ডারউইনবাদ মূলত এই তত্ত্বের উত্তরসূরী।

আর্কিওপটেরিক্স

আদি পাখির জীবাশ্ম (Archeopteryx-Ancient Bird Fossil)- আদি পাখির নাম আর্কিওপটেরিক্স(Archeaopteryx lithographica) যা অর্থ ancient wing inscribed in stone)। এদের কোন সদস্য বর্তমানে জীবিত নেই।

আজ হতে ১৪ কোটি ৭০ লক্ষ বছর পূর্বে জুরাসিক যুগে এর আবির্ভাব হয়েছিল। এই পাখির ধ্বংসাবশেষ জার্মানীর ব্যাভেরিয়ার বিখ্যাত সােলেনহােপেন অঞ্চল হইতে সংগ্রহ করা হয়। মােট ১০টি জীবাশ্ম আবিষ্কৃত হয় যার মধ্যে সর্বশেষটি আবিষ্কৃত হয় ২০০৭ সালে।

আর্কিওপটেরিক্স এর মধ্যে সরীসৃপ এবং পাখি উভয় জাতের বৈশিষ্ট্যগুলাে বিদ্যমান যার জন্য একে সংযােগকারী যােগসূত্র (connecting link) হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

আর্কিওপটেরিক্স এ সরীসৃপ বৈশিষ্ট্য

 ১. লেজ অনেকগুলাে কশেরুকা দ্বারা তৈরি। ২. অগ্রপদে নখরযুক্ত আঙুল ৩. চোয়ালে সম-আকৃতির অনেকগুলাে দাঁত বিদ্যমান।

আর্কিওপটেরিক্স এ পাখির বৈশিষ্ট্য

১. সমস্ত দেহ পালক দ্বারা আবৃত, ২. চোয়াল পাখির চঞ্চুর ন্যায় লম্বা ৩. ডানা আকৃতির অগ্র পা, ৪। সামগ্রিকভাবে এর দেহ পাখির ন্যায়।

আর্কিওপটেরিক্স আধা-পাখি ও আধা সরীসৃপ হওয়ায় প্রমাণ হয় যে, বিবর্তনের দ্বারা সরীসৃপকূল হতে আর্কিওপটেরিক্স এর মাধ্যমে আধুনিক পাখির উদ্ভব হয়েছে।

জীবাশ্মগত প্রমাণ (Palaeontological Evidence)

জীবাশ্ম বা ফসিল (Fossil), ল্যাটিন Fossilis শব্দ থেকে ইংরেজি Fossil শব্দের উৎপত্তি। Fossilis শব্দের অর্থ হলাে dug out বা খুড়ে তােলা। পূর্বে মাটি খুড়ে যা কিছু তােলা হতাে তাকেই জীবাশ্ম বা ফসিল বলা হতাে।

বর্তমানে, পৃথিবীর ভূত্বকে (crust) প্রাকৃতিক উপায়ে সংরক্ষিত প্রাগৈতিহাসিক জীবের দেহ, দেহাবশেষ বা দেহের কোন অংশের চিহ্ন বা সাক্ষ্যকে জীবাশ্ম বা ফসিল বলা হয়।

Stickberger (১৯৯৮) এর মতে “Fossilis are geological remains, impressions or trace of organisms that existed in the past” 217sfogliste জীবের সাক্ষ্য বা চিহ্ন হিসেবে মােল্ড (mold), কাস্ট (cast), হাত বা পায়ের ছাপ, গমন পথ (track), ট্রেইল (trail), গর্ত(boring), মলাশ্ম বা কপ্রােলাইট (coprolite) কে জীবাশ্ম হিসেবে বিবেচনা করা হয়। গমন পথ, ট্রেইল এবং জীবজনিত গর্তকে ট্রেস ফসিল (trace fossil) বা ইকনােফসিল (ichnofossil) বা জার্মান ভাষায় লেবেনসুরেন (lebenspuren) নামে আখ্যায়িত করা হয়। জীবাশ্মগত বিদ্যাকে জীবাশ্মবিদ্যা বা প্যালেন্টোলজি (palaeontology) বলা হয়।

বিবর্তনের সর্বাপেক্ষা নির্ভরযােগ্য এবং প্রামাণিক সাক্ষ্য (উপাদান) হচ্ছে জীবাশ্ম। জীবাশ্ম সম্পর্কিত জ্ঞান সংগ্রহ করতে হলে ভূ-পৃষ্ঠের শিলাস্তর সম্বন্ধেও জ্ঞান লাভ করতে হয় বলে বিবর্তনের এই প্রমাণকে ভূতত্ত্বীয় প্রমাণ (geological evidence) ও বলা হয়।

কালের পরিবর্তনে পৃথিবীর বুকে বহু জীব ধ্বংস হয়ে গেছে। শিলার বিভিন্ন স্তরে চাপা পড়ে অনেকেই জীবাশ্মে পরিণত হয়েছে। শিলার বিভিন্ন স্তর হতে পৃথিবীর বয়স নির্ণয় করা যায়। একটি বিশেষ স্তরে প্রাপ্ত জীবাশ্ম যার অর্থ হলাে পৃথিবীর ঐ সময় কালে এটি জীবিত ছিল। পৃথিবীর বিভিন্ন শিলাস্তর থেকে ঘােড়া, হাতী, উট, মানুষ ইত্যাদির যে জীবাশ্ম সংগ্রহ করা সম্ভব হয়েছে তাদেরকে ধারাবাহিকভাবে সাজালে ঐ সকল প্রাণীর ক্রমবিবর্তন সম্বন্ধে পরিস্কার ধারণা করা সম্ভব হয়।

জীবাশ্মের এইরূপ রেকর্ড হতে দেখা যায় যে, ৬ কোটি বছর পূর্বে ইয়ােসিন যুগে উত্তর আমেরিকায় এবং ইউরােপে প্রাপ্ত ১১ ইঞ্চি উচ্চতাবিশিষ্ট শৃগাল আকৃতির ইয়ােহিপ্পাস (Eohippus) নামক প্রাণী হতে আধুনিক ঘােড়া ইকুয়াস (Equus) এর উদ্ভব হয়েছে। ইয়ােহিপ্পাস এর অগ্রপদে চারটি এবং পশ্চাৎ পদে তিনটি করে আঙুল ছিল। ক্রমবিকাশের মাধ্যমে ইয়ােহিপ্পাস পায়ের আঙুলের সংখ্যা হ্রাস করে, দেহের আকৃতির বৃদ্ধি এবং দাতের সংখ্যা ও গঠনে পরিবর্তন এনে বর্তমান ইকুয়াস তথা আধুনিক ঘােড়াটির সৃষ্টি করে।

Leave a Comment