নবম অধ্যায়ঃ মানব জীবনের ধারাবাহিকতা

প্রজনন

যে প্রক্রিয়ায় একটি অথবা দুইটি জীবের দেহ বা দেহ অংশ থেকে সাদৃশ্যপূর্ণ নতুন বংশধর সৃষ্টি হয় তাকে প্রজনন বলে।

প্রজননতন্ত্র

যে সকল অঙ্গ সমষ্টি প্রজনন কাজে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভূতিকা রাখে তাদের একত্রে প্রজননতন্ত্র বলে।

মানব প্রজননতন্ত্র

মানুষ একলিঙ্গ প্রাণী। স্ত্রী ও পুং প্রজননতন্ত্র ভিন্ন ভিন্ন প্রাণিতে উপস্থিত। স্ত্রী প্রাণিদেহে স্ত্রী প্রজননতন্ত্র এবং পুরুষ প্রাণিতে পুং প্রজননতন্ত্র উপস্থিত।

পুরুষ প্রজননতন্ত্র

যে যন্ত্রের সাহায্যে শুক্রাণু উৎপাদন, সঞ্চিতকরণ,পবিরহন ও দেহ থেকে বাইরে নিষ্ক্রান্ত হয় সে তন্ত্রকে পুরুষ (পুং) প্রজননতন্ত্র বলে।

মানব পুংজননতন্ত্র নিম্নলিখিত অংশগুলাে নিয়ে গঠিত-

১। শুক্রাশয় (Testis), ২। অণ্ডকোষ(Scrotum), ৩। এপিডিডাইমিস (Epididymis), ৪। শুক্রনালি বা ভাস ডিফারেন্স (Vas deferens), ৫। সেমিনাল ভেসিকল (Seminal vesicle), ৬। ক্ষেপণ নালি (Ejaculatory duct), ৭। মূত্রনালি (Urethra),৮। শিশ্ন (Penis), ৯। প্রজনন গ্রন্থিসমূহ (Glands)।

১। শুক্রাশয়

পুরুষ প্রজননতন্ত্রের প্রধান অঙ্গের নাম শুক্রাশয়। এদের সংখ্যা একজোড়া। দেহগহ্বরের বাইরে স্ক্রোটাম(Scrotum) বা অণ্ডকোষের ভেতর শুক্র রজ্জু (Spermatic duct) দ্বারা শুক্রাশয়দ্বয় ঝুলন্তভাবে অবস্থান করে। প্রতিটি শুক্রাশয় তিনটি আবরণী দ্বারা আবৃত থাকে। প্রতিটি শুক্রাশয় ২০০-৩০০টি ছােট ছােট খণ্ডাংশ বা লােবিউলে বিভক্ত, প্রত্যেক খণ্ডাংশ ২-৩টি সূক্ষ্ম পাকানাে সুতার মত সেমিনিফেরাস নালিকা এবং ইন্টারস্টিশিয়াল কোষ দ্বারা গঠিত।সেমিনিফেরাস নালিকার অন্তঃপ্রাচীরে শুক্রাণু মাতৃকোষ এবং সারটোলি কোষ অবস্থিত।

কাজ- ক। শুক্রাশয় শুক্রাণু উৎপাদন করে। খ। এটি টেস্টোস্টেরন হরমােন নিঃসরণ করে।

২। অণ্ডথলি বা স্ক্রোটাম

উদরীয় গহ্বরের বাইরে যে থলির অভ্যন্তরে শুক্রাশয় অবস্থান করে তাকে অণ্ডকোষ বা স্ক্রোটাম বলে। স্ক্রোটাম ভেতরের দিকে অসম্পূর্ণভাবে বিভক্ত হয়ে শুক্রাশয়দ্বয়কে পৃথক রাখে।

কাজ- স্ক্রোটাম শুক্রাণু উৎপন্নের অনুকূল তাপমাত্রা রক্ষা করে।

৩। এপিডিডাইমিস

এপিডিডাইমিস কুণ্ডলীকৃত অবস্থায় শুক্রাশয়ের পিছনের গাত্রে লাগানাে থাকে। এপিডিডাইমিসের শেষ প্রান্ত ভাস ডিফারেন্সের সাথে যুক্ত।

কাজ- ক। শুক্রাণুগুলাে এখানে মাসাধিক কাল সঞ্চিত থাকতে পারে। খ। এটি শুক্রাণুর চলন শক্তি এবং নিষেক ক্ষমতা বা উর্বরতা বৃদ্ধি করে।

৪। শুক্রনালি বা ভাস ডিফারেন্স

এপিডিডাইমিসের শেষ প্রান্ত থেকে বের হয়ে একটি অবিচ্ছিন্ন নালিকা হিসেবে মূত্রথলির নিচে সেমিনাল ভেসিকলের নালির সাথে যুক্ত হয়।

কাজ- ক। ভাস ডিফারেন্স সঙ্গমের সময় দ্রুত শুক্রাণু পরিবহন করে, খ। কিছু সময়ের জন্য শুক্রাণু জমা রাখাও এর কাজ।

৫। সেমিনাল ভেসিকল

মূত্রথলির নিম্নপ্রান্ত ও মলাশয়ের মাঝখানে অবস্থিত একজোড়া ক্ষুদ্র থলিকে সেমিনাল ভেসিকল বলে।

কাজ- ক। সিমেন তৈরির জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ পিচ্ছিল পদার্থ ক্ষরণ করে, খ। শুক্রাণুকে পুষ্টিদানের জন্য ফুক্টোজ সমৃদ্ধ পদার্থ সৃষ্টি করে।

৬। ক্ষেপণ নালি

সেমিনাল ভেসিকল এবং ভাস ডিফারেন্স বা শুক্রনালি একত্রে মিলিত হয়ে ক্ষেপণ নালি তৈরি করে। এটি প্রােস্টেট গ্রন্থির ভিতর দিয়ে মূত্রনালিতে উন্মুক্ত হয়।

কাজ- ক্ষেপণ নালির মাধ্যমে সেমিনাল ভেসিকলের ক্ষরণসহ শুক্রাণু ইউরেথ্রায় প্রবেশ করে।

৭। মূত্রনালি

এটি রেচনতন্ত্র ও প্রজননতন্ত্রের একটি সাধারণ নালি। এটি মূত্রথলি থেকে শুরু করে শিশ্নের শেষ মাথা পর্যন্ত বিস্তৃত।

কাজ- এ নালির মাধ্যমে বীর্য বাইরে স্খলিত হয় এবং মূত্র বের হয়।

৭। শিশ্ন

এ অঙ্গটি নলাকার পেশিবহুল এবং উত্থানশীল, এ অঙ্গের মধ্য দিয়ে মূত্রনালি বিস্তৃত থাকে।

কাজ- ক। এটি যৌন সঙ্গমে অংশ গ্রহণ করে, খ। এটি শুক্রাণু বিশিষ্ট বীর্যরস স্ত্রী জননতন্ত্রের ভেতর প্রেরণ করে।

পুং প্রজনন গ্রন্থিসমূহ

প্রজনন অঙ্গ সমূহকে সাহায্য করা এবং শুক্রাণুর পুষ্টি নিশ্চত করার জন্য পুং প্রজনন তন্ত্রে অনেক গ্রন্থি থাকে। গ্রন্থিগুলো সম্পর্কে আলোচনা করা হলো।

(ক) প্রােস্টেট গ্রন্থি

এটি মূত্রথলির নিচে অবস্থিত নাশপাতি আকৃতির একটি গ্রন্থি। এর প্রাচীর আংশিকভাবে গ্রন্থিময় এবং আংশিকভাবে পেশি ও তন্তুময়।

কাজ- (i) এ গ্রন্থি থেকে একধরনের ক্ষারীয় তরল নিঃসৃত হয় যা সিমেন বা বীর্য তৈরিতে সহায়তা করে, (ii) এ তরল PH নিয়ন্ত্রন ও শুক্রাণুর চলনে বিশেষ ভূমিকা পালন করে।

(খ) কাওপার গ্রন্থি

প্রােস্টেট গ্রন্থির নিচে মূত্রনালির দু’পাশে দুইটি ক্ষুদ্র গােলাকৃতির গ্রন্থি বিদ্যমান। এদের কাওপার গ্রন্থি বলে। এরা দুটি খাটো নালির মাধ্যমে মূত্রনালির সাথে যুক্ত থাকে।

কাজ- সঙ্গমের সময় পিচ্ছিল মিউকাস পদার্থ ক্ষরণ করে।

পুরুষ সেক্স হরমােনের প্রভাব

শুক্রাশয় থেকে টেস্টোস্টেরন নামক গুরুত্বপূর্ণ পুরুষ যৌন হরমােন নিঃসৃত হয়। এটি শুক্রাণু উৎপাদন করতে শুক্রাশয়কে উদ্বুদ্ধ করে এবং পুরুষের যৌন বৈশিষ্ট্যের বিকাশ ঘটায়। শুক্রাশয়ের সারটোলি কোষ অল্প পরিমাণ ইস্ট্রোজেন হরমােন নিঃসরণ করে যা শুক্রাণু তৈরিতে সহায়তা করে। এছাড়া সারটোলি কোষ নিঃসৃত ইনহিবিন হরমােন শুক্রাণু সৃষ্টি নিয়ন্ত্রণ করে।

স্ত্রী প্রজননতন্ত্র

স্ত্রীদেহে যে তন্ত্রের সাহায্যে ডিম্বাণু উৎপাদন পুরুষ দেহ থেকে আগত শুক্রাণু দ্বারা ডিম্বাণুর নিষেক,জাইগােট ও ভ্রণ বিকাশ সম্পন্ন হয় তাকে স্ত্রী প্রজননতন্ত্র বলে।

স্ত্রী প্রজননতন্ত্রে নিম্নলিখিত অংশগুলাে থাকে

১। ডিম্বাশয় (Ovary)

একজোড়া ডিম্বাশয় স্ত্রী জননতন্ত্রের প্রধান অঙ্গ। এদের আকৃতি উপবৃত্তাকার, কিছুটা কাঠ বাদামের মত। প্রতিটি পরিণত ডিম্বাশয় এর দৈর্ঘ্য ২.৫ থেকে ৫ সেন্টিমিটার, প্রস্থ ১.৫-৩ সেন্টিমিটার, পুরু প্রায় ১ সেন্টিমিটার। প্রতিটি ডিম্বাশয় মেসােভেরিয়াম নামক পেরিটোনিয়াম দ্বারা আবৃত এবং পেলভিসের অভ্যন্তরে শক্ত দৃঢ় যােজক কলা দ্বারা আটকানাে থাকে। প্রতিটি ডিম্বাশয় কর্টেক্স ও মেডুলা নিয়ে গঠিত।

কাজ- এখানে ডিম্বাণু সৃষ্টি হয় এবং স্ত্রী যৌন হরমােনসমূহ ক্ষরিত হয়।

ডিম্বনালি (Fallopian tube)

জরায়ুর দু’পাশে অবস্থিত দুটি পেশল ও প্রায় ১২ সে. মিটার লম্বা নালি। ডিম্বনালির এক প্রান্ত ডিম্বাশয়ের কাছে পেরিটোনিয়াম গহ্বর ও অন্য প্রান্ত জরায়ু গহ্বরে উন্মুক্ত। ডিম্বনালির যে প্রান্তটি পেরিটোনিয়াম গহ্বরে উন্মুক্ত, তা ফানেল আকৃতির এবং এ প্রান্ত থেকে কতগুলাে অভিক্ষেপ বের হয়ে ঝালর বা ফিমব্রি (Fimbriae) গঠন করে।

কাজ- ক। ডিম্বনালি ডিম্বাশয় থেকে পরিপক্ক ডিম্বাণুকে গ্রহণ করে জরায়ুতে পৌছে দেয়, খ। রস ক্ষরণ করে নিষেকের পরিবেশ সৃষ্টি করে এবং গ। এখানে নিষেক সংঘটিত হয়।

৩। জরায়ু (Uterus/Womb)

জরায়ু একটা ফাঁপা, পুরু প্রাচীর যুক্ত এবং পেশিগঠিত থলিকাকার অংশ। শ্রোণি গহ্বরে মূত্রাশয় ও মলাশয়ের মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত। জরায়ুর প্রাচীর ৩টি স্তরযুক্ত, বাইরের স্তরকে পেরিমেট্রিয়াম (Perimetrium),মাঝের স্তরকে মায়ােমেট্রিয়াম (Myometrium) এবং অন্তঃস্তরকে এন্ডােমেট্রিয়াম(Endometrium) বলে।

এন্ডােমেট্রিয়ামে জাইগােটের সংস্থাপন ঘটলে গর্ভধারণ হয়। জরায়ুর উপরের প্রশস্ত অংশকে জরায়ুদেহ (Body of uterus) এবং নিচের সংকীর্ণ ভাগকে জরায়ু গ্রীবা বা সারভিক্স (Cervix) বলে। জরায়ু দু’পাশে দুটি ডিম্বনালি এবং পিছনে যােনির সাথে সংযুক্ত থাকে। সারভিক্সের সরু পথে বীর্যরস জরায়ুতে প্রবেশ করে।

কাজ- ক। জরায়ুতে নিষিক্ত জাইগােট প্রতিস্থাপিত হয় এবং এখানেই ভ্রণের বিকাশ ঘটে, খ। জরায়ুর প্রাচীর থেকে অমরা গঠিত হয়, গ। অমরার মাধ্যমে জ্বণের পুষ্টি, রেচন ও শ্বসন সম্পন্ন হয়।

৪। যােনি (Vagina)

মূত্রনালির নিচ দিয়ে প্রসারিত ৮-১০ সেন্টিমিটার লম্বা নলাকার খাদকে যােনি বলে। এর এক প্রান্ত জরায়ুতে এবং অন্য প্রান্ত দেহের বাইরে উন্মুক্ত থাকে। যােনির প্রাচীরে রুগী নামক অসংখ্য ভাঁজ থাকে। দুটি মাংসল ভাঁজ কপাটের মত যােনিপথে ঢেকে রাখে। এদের লেবিয়া মেজরা (Labia majora) ও লেবিয়া মাইনরা (Labia minora) বলে।

লেবিয়া মেজরার উপরের দিকে একটি ছােট মাংসপিণ্ড থাকে। একে ক্লাইটোরিস বলে। এটি অত্যন্ত সংবেদনশীল।

কাজ- ক। সঙ্গমের সময় যােনি শিশ্ন গ্রহণ করে, খ। বীর্য স্থলনের জন্য প্রয়ােজনীয় উত্তেজনা প্রদান করে এবং স্থলিত বীর্য গ্রহন করে, গ। এর প্রাচীর থেকে মিউকাসযুক্ত পিচ্ছিল পদার্থ নিঃসৃত হয়ে সঙ্গমকে আনন্দময় করে এবং ঘ। সন্তান প্রসবের সময় এটি প্রসারিত হয়ে প্রসবকে সহজ করে।

স্ত্রী সেক্স হরমোনের প্রভাব

ডিম্বাশয় থেকে ক্ষরিত ইস্ট্রোজেন হরমোন ডিম্বাণু উৎপাদনে সাহায্য করে এবং প্রজেস্টেরন হরমোন ইমপ্লান্টেশন ও ভ্রূণ বিকাশে সাহায্য করে। অমরা থেকে ক্ষরিত রিলাক্সিন হরমোন সন্তান প্রসব সহজ করে।

Leave a Comment