দ্বিতীয় অধ্যায়ঃ মায়ােসিস কোষ বিভাজন

মায়ােসিস কোষ বিভাজন

সংজ্ঞা

মায়ােসিস একটি বিশেষ ধরনের কোষ বিভাজন প্রক্রিয়া যাতে মাতৃকোষের নিউক্লিয়াসটি দু’বার কিন্তু ক্রোমােসােমসমূহ একবার বিভাজিত হয়, ফলে সৃষ্ট চারটি কোষে ক্রোমােসােম সংখ্যা মাতৃকোষের ক্রোমােসােম সংখ্যার অর্ধেক হয়। তাই এ ধরনের বিভাজনকে হ্রাসমূলক বিভাজন বলে।

আবিষ্কার

বেনেডিন এবং হাউসার (১৮৮৩) কৃমির গ্যামিটে হ্যাপ্লয়েড (n) সংখ্যক ক্রোমােসােম আবিষ্কার করেন। Strashburger ১৮৮৮ সালে পুষ্পক উদ্ভিদের জনন মাতৃকোষের ক্রোমােসােমে হ্রাসমুলক বিভাজন প্রত্যক্ষ করেন। J. B. Farmer ও J. E. Moore ১৯০৫ সালে সর্বপ্রথম হ্রাসমুলক বিভাজনকে মায়ােসিস বলেন।

মায়ােসিস কোষ বিভাজন কোথায় ঘটে

মায়ােসিস সর্বদা জনন মাতৃকোষে সম্পন্ন হয়। কখনই দৈহিক কোষে মায়ােসিস ঘটে না। মায়ােসিস সর্বদাই ডিপ্লয়েড (2n) সংখ্যক ক্রোমােসােমবিশিষ্ট কোষে সংঘটিত হয়। নিম্নশ্রেণির জীবে(হ্যাপ্লয়েড) মায়ােসিস ঘটে নিষেকের পর জাইগােটে।

অপরদিকে উচ্চশ্রেণির জীবে (ডিপ্লয়েড) মায়ােসিস হয় নিষেকের পূর্বে জনন মাতৃকোষ থেকে গ্যামিট সৃষ্টির সময়। ডিপ্লয়েড জীবে গ্যামিট সৃষ্টির সময় জনন মাতৃকোষে এবং হ্যাপ্লয়েড জীবের জাইগােটে মায়ােসিস ঘটে বিধায় প্রজাতির বৈশিষ্ট্য বংশ পরম্পরায় টিকে থাকে।

মায়ােসিস কোষ বিভাজনের ধাপ

মাইটোসিসের ন্যায় মায়ােসিসও একটি অবিচ্ছিন্ন ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। কোষ, নিউক্লিয়াস এবং ক্রোমােসােম এর বিভক্তির উপর ভিত্তি করে মায়ােসিস কোষ বিভাজনকে দুটি পর্বে ভাগ করা হয়। যথা-

(ক) মায়ােসিস-১ এবং

(খ) মায়ােসিস-২।

মায়ােসিস প্রক্রিয়ায় একটি কোষ পরপর দু’বার বিভক্ত হয়। কোষের প্রথম বিভাজনের সময় অপত্য কোষে ক্রোমােসােম সংখ্যা মাতৃকোষের ক্রোমােসােম সংখ্যার অর্ধেক হয়। প্রথম বিভাজনের জন্য একে মায়ােসিস-১ নামকরণ করা হয়েছে। যেহেতু মায়ােসিস-১ এ ক্রোমােসােম সংখ্যা হ্রাস পায় তাই মায়ােসিস কোষ বিভাজনকে হ্রাসমুলক বিভাজনও বলা হয়।

মায়ােসিস কোষ বিভাজনে মায়ােসিস-১ সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ এ পর্যায়ে ক্রোমােসােম সংখ্যা অর্ধেক হ্রাস পায় এবং ক্রসিং ওভার ঘটে।

একজোড়া সমসংস্থ ক্রোমােসােমের দুটি নন-সিস্টার ক্রোমাটিড এর মধ্যে অংশের বিনিময়কে বলা হয় ক্রসিংওভার।

এরপর কোষের দ্বিতীয় বিভাজনকে মায়ােসিস-২ বলা হয়। মায়ােসিস-২ এর প্রধান তাৎপর্য হলাে দুটি কোষ থেকে চারটি কোষের উৎপত্তি। এটি মূলত মাইটোসিস কোষ বিভাজনের ন্যায়।

(ক) মায়ােসিস-১

মায়ােসিসের এ পর্যায়ে ডিপ্লয়েড (2n) কোষের ক্রোমােসােম সংখ্যা হ্রাস পেয়ে অর্ধেক হয় এবং সমসংস্থ (Homologous) ক্রোমােসােমের মধ্যে পারস্পরিক অংশের বিনিময় (Crossing Over) হয়।

মায়ােসিস-১ এর পর্যায়

১। প্রােফেজ-১,

২। মেটাফেজ-১,

৩। অ্যানাফেজ-১ ও

৪। টেলােফেজ-১

১।প্রােফেজ-১

প্রােফেজ-১

পর্যায়টি দীর্ঘস্থায়ী। এ পর্যায়ে নিউক্লিয়াসটি আকারে বৃদ্ধি পায় এবং ক্রোমােসােমের DNA এর পরিমাণ প্রায় দ্বিগুণ হয়। এ পর্যায়কে পাঁচটি উপ পর্যায়ে ভাগ করা হয়েছে। যথা—

i. লেপ্টোটিন, ii. জাইগােটিন, iii.প্যাকাইটিন, iv. ডিপ্লটিন এবং v. ডায়াকাইনেসিস।

i. লেপ্টোটিন (Leptotene)

গ্রীক Leptos = চিকন, পাতলা ; Tene = সুতা)-প্রােফেজ-১ এর লেপ্টোটিন উপ পর্যায়ে নিউক্লিয়াসে পানি বিয়ােজন শুরু হয়। ক্রমাগত পানি বিয়ােজনের ফলে ক্রোমােসােমও ক্রমান্বয়ে সংকুচিত ও পুরু হতে থাকে। যৌগিক অণুবীক্ষণযন্ত্রে ক্রোমােসােমগুলােকে সুতার ন্যায় মনে হয়। ক্রোমােসােমগুলাে অবিভক্ত, দীর্ঘ ও জট পাকানাে অবস্থায় থাকে বলে এদের সংখ্যা নির্ণয় করা যায় না। প্রতিটি ক্রোমােসােমে বহু ক্রোমােমিয়ার দেখা যায়।

ii. জাইগােটিন (Zygotene)

গ্রিক Zygos = জোড়া, Tene = সুতা)-এ উপপর্যায়ে সমসংস্থ বা হােমােলােগাস (Homologous)একই আকৃতি ও জিনের একই প্রকার সজ্জারীতিসম্পন্ন ক্রোমােসােমদ্বয় যার একটি ঐ জীবের মাতা ও অন্যটি পিতা থেকে আসে) ক্রোমােসােমগুলাে পাশাপাশি অবস্থান করে।

হােমােলােগাস ক্রোমােসােমদ্বয়ের মধ্যে পরস্পর আকর্ষণের ফলে একটি জোড়ার সৃষ্টি হয় এবং পরস্পরের সাথে জোড়া সৃষ্টি করাকে সিন্যাপসিস (Synapsis) বলে ।

হােমােলােগাস ক্রোমােসােমের প্রত্যেকটি জোড়াকে এক একটি বাইভেলেন্ট (Bivalent) বলে।বাইভেলেন্ট সৃষ্টির প্রকৃিয়াকে সাইন্যাপসিস বলে।

কাজেই কোষে যতগুলাে ক্রোমােসােম থাকবে তার অর্ধেক সংখ্যক বাইভেলেন্ট সৃষ্টি হবে। এ উপপর্যায়ে নিউক্লিয়ার এনভেলাপ ও নিউক্লিয়ােলাস অবিকৃত অবস্থায় থাকে।

iii. প্যাকাইটিন (Pachytene)

গ্রীক- Pachys = মােটা, পুর; Tene = সুতা)-এ উপপর্যায়ে ক্রোমােসােমগুলাে আরও মােটা ও খাটো হয়। বাইভেলেন্টের প্রতিটি ক্রোমােসােম সেন্ট্রোমিয়ার অংশ ব্যতীত দৈর্ঘ্য বরাবর বিভক্ত হয়। ফলে প্রতি বাইভেলেন্টে দুটি সেন্ট্রোমিয়ার ও চারটি ক্রোমাটিড থাকে। প্যাকাইটিনের পূর্বে প্রতিটি ক্রোমােসােমের দুটি করে ক্রোমাটিড দেখা যায় না।

এখানে উলেখ্য যে, একই মাতৃ ক্রোমােসােমের দুটি ক্রোমাটিডকে সিস্টার ক্রোমাটিড (Sister Chromatid) এবং একই বাইভেলেন্ট বা জোড়ার প্রতিটি ক্রোমােসােম থেকে একটি করে ক্রোমাটিড নিয়ে গঠিত দুটি ক্রোমাটিডকে নন সিস্টার ক্রোমাটিড (Non sister Chromatid) বলা হয়।

এ উপপর্যায়ে ক্রোমােসােমগুলাে আরও মােটা ও খাটো হয়, তবে এ উপপর্যায়ের শেষের দিকে বাইভেলেন্ট ক্রোমােসােমগুলাের মধ্যে আকর্ষণ শক্তির পরিবর্তে বিকর্ষণ শক্তি পরিলক্ষিত হয়। এজন্য বাইভেলেন্টের ক্রোমােসােম দুটি পরস্পর হতে পৃথক হতে থাকে। এ সময় বাইভেলেন্টের দুটি নন সিস্টার ক্রোমাটিড বিভিন্নস্থানে ‘X’ চিহ্নের ন্যায় যুক্ত থাকে।

দু’টি নন সিস্টার ক্রোমাটিডের ‘X’ চিহ্নিত জোড়াস্থলকে একবচনে কায়েজমাটা এবং বহুবচনে কায়াজমা বলে। নন সিস্টার ক্রোমাটিডের এরূপ পরস্পর অংশ বিনিময়ের প্রক্রিয়াকে ক্রসিং ওভার বলে। ক্রসিং ওভারের ফলে ক্রোমােসােমের যে অংশের বিনিময় হয়, তাতে ক্রোমােসােমের গুণগতমানের পরিবর্তন সাধিত হয়। এ উপপর্যায়েও নিউক্লিয়ার মেমব্রেন ও নিউক্লিয়ােলাস দেখা যায়।

iv. ডিপ্লটিন (Diplotene)

গ্রীক- Diplos = ডবল ; Tene = সুতা)-এ উপপর্যায়ে ক্রোমােসােমগুলাে আরও মােটা ও খাটো হয়। বাইভেলেন্টের দুটি ক্রোমােসােম একে অপরের থেকে আরও দূরে সরে যেতে থাকে কিন্তু কায়াজমা স্থানে বাধা পায়। ক্রোমােসােমদ্বয়ের পরস্পরের প্রতি এ বিকর্ষণ একসঙ্গে কয়েকস্থানে শুর হতে পারে। তবে সাধারণত প্রথমে সেন্ট্রোমিয়ার দ্বয়ের মধ্যে শুরু হয়। ক্রোমােসােম দুটির বিকর্ষণ বৃদ্ধির সাথে সাথে কায়াজমা ক্রোমােসােমের প্রান্ত্রে দিকে সরে যেতে থাকে। ক্রোমােসােমের প্রান্ত্রে দিকে কায়াজমার এ গমনকে প্রান্তিয়করণ (Terminalization) বলে ।

বিকর্ষণের ফলে দুটি কায়াজমার মধ্যবর্তী স্থানে ফাঁসের (Loop) সৃষ্টি হয়। অতঃপর ক্রোমােসােমের বাহুসমূহের তথা লুপ সমূহের পারস্পরিক আবর্তন দেখা যায়। যেখানে বাহুদ্বয়ের মধ্যে একটিমাত্র কায়াজমা থাকে, সেখানে বাহুদ্বয় ১৮০° কোণ উৎপন্ন করে অবস্থান করে।

ডায়াকাইনেসিস(Diakinesis)

গ্রিক- Dia = অপর পাশে ; Kinesis = সমাবেশ)-এ উপ পর্যায়ে ক্রোমােসােমগুলাে আরও মােটা ও খাটো হয়। প্রান্তিয়করণ তখনও চলতে থাকে এবং শেষে কায়াজমাগুলাে বাইভেলেন্টের প্রান্তে পৌছায়। বাইভেলেন্টগুলাে নিউক্লিয়াসের কেন্দ্রস্থল হতে পরিধির দিকে চলে আসে। নিউক্লিয়ােলাস অদৃশ্য হয় এবং নিউক্লিয়ার এনভেলাপ এর অবলুপ্তি ঘটতে থাকে। এ উপপর্যায়ের শেষ ভাগে নিউক্লিয়ার এনভেলাপের সম্পূর্ণ অবলুপ্তি ঘটে।

মেটাফেজ-১

এটি মাইটোসিসের মেটাফেজের অনুরূপ, তবে বিষুবীয় অঞ্চলে বিভক্ত ক্রোমােসােমের পরিবর্তে বাইভেলেন্টগুলাে বিন্যাস্ত থাকে। বাইভেলেন্টের দুটি সেন্ট্রোমিয়ারের একটি এক মেরুর দিকে (যেমন- উপরের মেরুর দিকে) এবং অন্যটি অপর মেরুর দিকে (যেমন- নিচের মেরুর দিকে) মুখ করে অবস্থান করে এবং সেন্ট্রোমিয়ার দুটি বিষুবীয় রেখা হতে সমদূরে থাকে। কতিপয় আকর্ষণ তন্তুর সাথে (একে ক্রোমােসােমাল তন্তু বা ট্র্যাকশন ফাইবার বলা হয়) ক্রোমােসােমের সেন্ট্রোমিয়ার যুক্ত থাকে।

অ্যানাফেজ-১

এ পর্যায়ে বাইভেলেন্টের দুটি ক্রোমােসােম (ক্রোমাটিড নয়) দু’বিপরীত মেরুর দিকে অগ্রসর হতে থাকে। ক্রোমােসােমের এ ধরনের চলনের সময় সেন্ট্রোমিয়ার অগ্রগামী হয় এবং ক্রোমােসােমের বাহু অনুগামী হয়। ফলে ক্রোমােসােমগুলাে V (মেটাসেন্ট্রিক), L (সাবমেটাসেন্ট্রিক), J (অ্যাক্রোসেন্ট্রিক) ও I (টেলােসেন্ট্রিক) প্রভৃতি আকার ধারণ করে। এ পর্যায়ে প্রতিটি কোষ মেরু অভিমুখে দেহ কোষীয় ক্রোমােসােমের অর্ধেক সংখ্যক ক্রোমােসােম গমন করে। অর্থাৎ প্রতিটি মেরতে ক্রোমােসােম সংখ্যা অর্ধেক হয় ।

টেলােফেজ

এ পর্যায়ে ক্রোমােসােমগুলাে মেরুপ্রান্তে চলে আসে। প্রান্তে পৌছানাে ক্রোমােসােমগুলাের পাক খুলে যায় এবং পানি যােজনের ফলে লম্বা সরু সুতার ন্যায় ক্রোমাটিড গঠন করে। নিউক্লিয়ােলাসের পুনরাবির্ভাব হয় এবং নিউক্লিয়ার এনভেলাপের সৃষ্টি হয়। এভাবে দুটি অপত্য নিউক্লিয়াসের সৃষ্টি হয় যাদের ক্রোমােসােম সংখ্যা মাতৃকোষের (2n) অর্ধেক সংখ্যক (n) হয়।

ইন্টারকাইনেসিস

মায়ােসিস প্রক্রিয়ায় নিউক্লিয়াসের প্রথম ও দ্বিতীয় বিভক্তির অন্তর্বর্তীকালীন বা মধ্যবর্তী সময়কে ইন্টারকাইনেসিস বলা হয়। এ সময়ে দরকারী আরএনএ (RNA),প্রােটিন ইত্যাদি সংশে[ষিত হয়। ডিএনএ (DNA)এর প্রতিরূপ বা অনুলিপন ঘটে না।

Leave a Comment