দ্বাদশ অধ্যায়ঃপ্রাণির আচরণ

আচরণ

উদ্দীপকের প্রতি প্রাণীর প্রতিক্রিয়া প্রদর্শনের নামই আচরণ।

প্রখ্যাত আচরণবিদ ম্যানিং(Manning) এর মতে, আচরণ হলো কিছু বিশেষ ক্রিয়ার সমষ্টি যার মাধ্যমে প্রাণী তার বহিঃপরিবেশ এবং দেহের অভ্যন্তরের অবস্থা সম্পর্কে জ্ঞাত হয় এবং তার কাঙ্খিত চাহিদার প্রেক্ষিতে প্রতিক্রিয়া করে।

আচরণবিদ্যা(Ethology)

জীববিজ্ঞানের যে শাখায় প্রাণীর আচরণ সম্পর্কে বৈজ্ঞানিক ও বস্তুনিষ্ঠ আলােচনা করা হয় তাকে আচরণবিদ্যা (Ethology) বলা হয়।

Ethology শব্দটি দুটি গ্রিক শব্দ তথা‘ethos’ (স্বভাব) ও ‘logos’ (জ্ঞান) এর সমন্বয়ে গঠিত। প্রাণিবিজ্ঞানের একটি বিশেষ শাখা আচরণবিদ্যা বা Ethology ইথােলজিতে আচরণ শব্দটি ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত হয়ে থাকে।

আচরণের প্রকৃতি ও উদ্দীপনায় আচরণগত পরিবর্তন

আচরণের প্রকৃতি

প্রাণীর সংরক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রাণীর আচরণ অনুধাবন করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রাণ আচরণের প্রকৃতি নিম্নরূপ

১) উদ্দীপকের প্রতি প্রাণীর সাড়া দেয়ার দৃশ্যমান কৌশল হলাে আচরণ, যা সে পরিবেশে টিকে থাকার জন্য করে থাকে।

এটি সাধারণত বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ উদ্দীপকের প্রতি সমন্বিত প্রতিক্রিয়া যা নিম্ন উপায়ে সম্পন্ন হয়-

উদ্দীপক প্রদর্শন(আভ্যন্তরীণ/বাহ্যিক)………গ্রাহক…..প্রাণিদেহের আভ্যন্তরীণ প্রতিক্রিয়া…..সঞ্চালক…..প্রাণী কর্তৃক সাড়া/আচরণ প্রদর্শন

৩) আচরণ প্রকাশের জন্য প্রেষণা প্রয়ােজন, যেমন- ইচ্ছা বা আগ্রহ।

৪) প্রাণীর আচরণ অভিযােজনমূলক ও বিবর্তনমূলক। নিজ প্রয়ােজনে বা পরিবেশে গ্রহণযােগ্যতা পাবার জন্য প্রাণী তার মূল আচরণকে পরিবর্তিত করে ।

৫) নির্দিষ্ট প্রজাতির প্রাণী নির্দিষ্ট উদ্দীপকের প্রতি একই রকমের সাড়া দেয়।

৬) জন্মগত উপাদান (জিন) এবং বাহ্যিক পরিবেশ উভয়ই প্রাণীর আচরণকে প্রভাবিত করে ।

৭) মূলতঃ আচরণ দু’ধরনের, যথা- সহজাত আচরণ ও শিখন আচরণ। তবে সমাজবদ্ধ প্রাণীদের মধ্যে এ দু’ধরনের আচরণের সমন্বয়ে সামাজিক আচরণেরও বিকাশ ঘটে।

উদ্দীপনায় আচরণগত পরিবর্তন

উদ্দীপনার কারণে প্রাণীদের মধ্যে বিভিন্ন রকমের আচরণগত পরিবর্তন দেখা যায়।

উদ্দীপক

বাহ্যিক পরিবেশের পরিবর্তন বা প্রাণিদেহের আভ্যন্তরস্থ শারীরবৃত্তীয় বা মনস্তাত্ত্বিক যেকোনাে ধরনের পরিবর্তনের কারণে প্রাণী সাড়া প্রদান করলে সেই পরিবর্তন গুলোকে উদ্দীপক বলে।

উদ্দীপনা

উদ্দিপকের ক্রিয়াকে বলে উদ্দীপনা।

উদ্দীপক এর প্রকারভেদঃ উদ্দীপক প্রধানত ২ ধরণের।যথা-

বাহ্যিক উদ্দীপক

প্রাণিদেহের বাহিরে অবস্থিত কোন উদ্দীপক দেহে সাড়া সৃষ্টি করতে সক্ষম হলে তাকে  বাহ্যিক উদ্দীপক বলে।

উদাহরণ:

রেসাস বানর (Macaca mulatta) প্রজাতির সদস্যরা সাধারণভাবে পরস্পর থেকে একটু আলাদা থাকলেও প্রচণ্ড শীতের তীব্রতা থেকে বাঁচার জন্য পরষ্পর জড়াজড়ি করে অবস্থান করে। তাদের এ আচরণ দেহের উষ্ণতা বাড়াতে সহায়তা করে। বাহ্যিক পরিবেশের তাপমাত্রার পরিবর্তনের সাথে খাপ খাওয়ানাের জন্যই রেসাস বানর এরূপ আচরণ করে। এক্ষেত্রে তাপমাত্রা বাহ্যিক উদ্দীপক হিসেবে কাজ করে।

আভ্যন্তরীণ উদ্দীপক

আবার প্রজনন ঋতুতে পুরুষ কোলা ব্যাঙের যৌন হরমােন নিঃসৃত এবং তার প্রভাবে পুরুষ ব্যাঙ স্ত্রী ব্যাঙকে আকর্ষণ করার জন্য স্বর থলিকে ফুলিয়ে উচ্চস্বরে ডাকতে থাকে। এক্ষেত্রে হরমােনের পরিবর্তন একটি আভ্যন্তরীণ উদ্দীপক হিসেবে কাজ করে।

বাহ্যিক উদ্দীপকগুলােকে দু’ভাগে ভাগ করা যেতে পারে, যেমন- ভৌত উদ্দীপক (তাপ, চাপ, আলাে, স্পর্শ, শব্দ, গন্ধ) ও রাসায়নিক উদ্দীপক । আবার আভ্যন্তরীণ উদ্দীপকগুলােকেও দু’ভাগে ভাগ করা যেতে পারে, যেমন- রাসায়নিক উদ্দীপক ও স্নায়ুবিক উদ্দীপক।

তবে যেকোনাে ধরনের উদ্দীপকই প্রাণীর স্নায়ুতন্ত্র, অন্তঃক্ষরা গ্রন্থি ও পেশিতন্ত্রের সমন্বয়ে আচরণের বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। প্রাণীর অধিকাংশ উদ্দীপকই সুনির্দিষ্ট এবং এগুলাে খুব দ্রুত আচরণের পরিবর্তন ঘটায়।

অধিকাংশ প্রাণী একাধিক ধরনের উদ্দীপকের প্রতি সাড়া দেয়। প্রাণী চার ধরনের উদ্দীপকের প্রতি সাড়া দিয়ে আচরণের পরিবর্তন ঘটায়। এগুলাে হলাে-

১। রাসায়নিক উদ্দীপক (Chemical stimuli)

বিভিন্ন প্রয়ােজনে প্রাণীরা বায়ুতে বা পানিতে খুব অল্প পরিমাণে রাসায়নিক উদ্দীপকের নিঃসরণ ঘটায়। এগুলাে প্রজাতি নির্দিষ্ট। প্রাণীর যৌন মিলন, সীমানা নির্ধারণ, গমন পথ চিহ্নিতকরণ, শাবক শনাক্তকরণ ইত্যাদি বিভিন্ন আচরণে রাসায়নিক উদ্দীপক ব্যবহৃত হয়। Sex pheromone একটি রাসায়নিক উদ্দীপক যা দ্বারা প্রাণী তার বিপরীত লিঙ্গকে আকর্ষণ করে।

২। শব্দ উদ্দীপক (Sound stimuli)

শব্দ প্রাণীর অন্যতম প্রধান যােগাযােগ মাধ্যম। এ উদ্দীপনায় প্রাণীর আচরণের দ্রুত পরিবর্তন ঘটে। সাধারণত দূরে অবস্থানরত সদস্যের সাথে যােগাযােগ করার জন্য শব্দ উদ্দীপক ব্যবহৃত হয়। প্রাণীর যৌন মিলন, শিকারী হতে সতর্ক করা, স্বজাতি শনাক্তকরণ, খাদ্যের প্রাচুর্যের সংবাদ দেয়া ইত্যাদি বিভিন্ন আচরণে শব্দ উদ্দীপক ব্যবহৃত হয়।

৩। দর্শন উদ্দীপক (Visual stimuli)

দেখতে সক্ষম প্রাণীর ক্ষেত্রে আলােক একটি উত্তম যােগাযােগ মাধ্যম। নিশাচর প্রাণীরা সাধারণ আলােতে দেখে না কিন্তু তারা আলাের অবলােহিত (infraed) তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের মাধ্যমে বিভিন্ন বস্তু শনাক্ত করে। মরুভূমির সাপ রাতের বেলায় এ পদ্ধতিতে উষ্ণ রক্তবিশিষ্ট প্রাণী শিকার করে। গভীর সমুদ্রে বসবাসকারী অনেক মাছ এবং কিছু পতঙ্গের আলােক উৎপাদনকারী অঙ্গ আছে যা তাদের চলাচল, শিকার ধরা ও প্রজননের কাজে ব্যবহৃত হয়।

অনেক প্রাণী যেমন- বানর, হাতি, শিম্পাঞ্জি প্রভৃতি তাদের অঙ্গভঙ্গি দ্বারা বিভিন্ন রকম আচরণ প্রদর্শন করে সমগােত্রীয় কিংবা অন্য প্রজাতির সদস্যদের আকর্ষণ করে। পাখি তার বাচ্চার হা করা মুখ দেখে দ্রুত সাড়া দিয়ে মুখে খাবার ফেলে।

৪। স্পর্শ উদ্দীপক (Touch stimuli)

প্রাণিজগতের বিভিন্ন প্রজাতিতে স্পর্শ উদ্দীপকের ব্যাপক ব্যবহার রয়েছে। শারীরিক সংযােগের দ্বারা স্পর্শ উদ্দীপক প্রাণীর আচরণের পরিবর্তন ঘটায়। কিছু পতঙ্গভােজী স্তন্যপায়ী প্রাণী এবং জেলি ফিশ স্পর্শ উদ্দীপক দ্বারা তাদের খাদ্য সংগ্রহ করে। অনেক পতঙ্গভােজী স্তন্যপায়ীর (যেমন-চিকা) তুণ্ডে এমন লােম থাকে যা দ্বারা এরা ০.১ মিলিমিটার দৈর্ঘ্যের খাদ্যকেও শনাক্ত করতে পারে। সামাজিক পতঙ্গ মৌমাছির কর্মীগুলাে তরুণ মৌমাছির অ্যান্টিনার সংস্পর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে খাবার দিতে উদ্বুদ্ধ হয়।

Leave a Comment