আচরণ ও বংশগতির সম্পর্ক

আচরণ ও বংশগতির সম্পর্ক

Sir Francis Galton (১৮২২-১৯১১) নামক একজন বিজ্ঞানী সর্বপ্রথম প্রাণীর আচরণ ও বংশগতির উপর বিশ্লেষণধর্মী গবেষণা করেন। প্রাণীর আচরণ সম্পর্কিত বংশগতিবিদ্যা জীববিজ্ঞানের একটি নতুন শাখা যেখানে প্রাণীর আচরণে জিন ও পরিবেশের প্রভাব সম্পর্কে অধ্যয়ন করা হয়।

আচরণের জীবতাত্ত্বিক ভিত্তি (Biological basis of behaviour)

১। প্রাণীর আচরণ প্রজাতি নির্দিষ্ট (species specific)। যৌন আচরণে এ বৈশিষ্ট্য অত্যন্ত সুস্পষ্ট। কোন একটি প্রজাতির প্রাণীতে যে ধরনের যৌন আচরণ দেখা যায় তার অতি নিকট সম্পর্কীয় প্রাণীতে সে ধরনের আচরণ দেখা যায় না।

আচরণের পার্থক্য দ্বারা অনেক সিবলিং প্রজাতির (দুটি প্রজাতি দেখতে প্রায় একই রকম) মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করা হয়। প্রাণীর আচরণের এ ধরনের বৈশিষ্ট্য উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত।

২। প্রাণীর আচরণ বংশ পরম্পরায় সঞ্চারিত হয়। প্রাণীর সকল সহজাত আচরণ হাজার বছর ধরে এক জনু (Generation) থেকে অন্য জনুতে অপরিবর্তিত অবস্থায় সঞ্চারিত হয়।

৩। প্রাণীর কোন অঙ্গ বা প্রক্রিয়ায় জৈবিক পরিবর্তন দ্বারা আচরণের পরিবর্তন ঘটে। যেমন- নিয়মিত ঔষধ প্রয়ােগের মাধ্যমে মানসিক রােগীর মস্তিষ্কে রসায়ন পরবর্তন করে বিকৃত আচরণকে স্বাভাবিক অবস্থায় নিয়ে আসা যায়।

৪। মানুষের কিছু আচরণ পরিবারের মধ্যে বংশ পরম্পরায় সঞ্চারিত হয়। যেমন, অনেক পরিবারের মানসিক রােগী ধারাবাহিকভাবে দেখা যায়।

৫। প্রাণীর প্রতিটি আচরণের একটি বিবর্তনিক ইতিহাস থাকে যার ফলে অনেক আচরণ নিকটতম কয়েকটি প্রজাতির মধ্যে পরিলক্ষিত হয়। যেমন, জিনের গঠনের দিক থেকে শিম্পাঞ্জি মানুষের অত্যন্ত ঘনিষ্ট। মাত্র ২% জিন দ্বারা এরা মানুষ হতে আলাদা।

এজন্য অনেক সামাজিক আচরণ যেমন- সন্তান বাৎসল্য, পরস্পরের সহযােগিতা, নেতৃত্ব প্রভৃতিতে শিম্পাঞ্জি ও মানুষের মিল পাওয়া যায়। জিন কিভাবে আচরণকে প্রভাবিত করে? প্রাণীর আচরণ কোন একক জিন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় না। বিভিন্ন লােকাসে অবস্থিত একাধিক জিন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় বলে আচরণ প্রাণীর একটি জটিল বৈশিষ্ট্য।

গবেষণায় দেখা গেছে একটি জিনের অতিমাত্রায় প্রকাশ ইদুরের শিখন ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। এধরনের জিনকে বিজ্ঞানীরা শিখন জিন (learning gene) বা স্মার্ট জিন (Smart gene) নাম দিয়েছেন।

প্রাণীর জিন নির্ধারিত যেসব আচরণ ধারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রদর্শিত হয় এবং নিজ প্রজাতির অন্য সদস্যকে না দেখে বা কারাে কাছ থেকে না শিখেই প্রকাশিত হয় তাকে নির্ধারিত ক্রিয়া ধারা বা ফিক্সড অ্যাকশন প্যাটার্ন (fixed action pattern-FAP)বলে।

এরূপ পরিস্থিতিতে একই বয়সের ও একই লিঙ্গের কোন প্রাণীকে স্বগােত্রীয় অন্যদের থেকে আলাদা করে রাখলেও অজান্তেই এরূপ আচরণের বহিঃপ্রকাশ ঘটে। প্রাণিজগতে আচরণের অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে যেখানে একই প্রজাতির সকল সদস্যের মধ্যে বিশেষ আচরণ প্রত্যক্ষ করা যায়। এ ধরনের আচরণ পূর্ব অভিজ্ঞতালব্ধ নয় কিংবা শিক্ষার মাধ্যমে অর্জিত নয়। এসব আচরণ নির্ধারিত ক্রিয়া সংশ্লিষ্ট বা FAP কেন্দ্রিক। FAP কেন্দ্রিক আচরণ জিন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় বলে এটি প্রাণীর জিনােমে পূর্বানুক্রমিত (Preprogrammed) অবস্থায় সংরক্ষিত থাকে। তাই এটি প্রজাতি নির্দিষ্ট যা প্রজাতির স্মৃতি (Species memory) হিসেবে এক জনু থেকে অন্য জনুতে সঞ্চারিত হয়।

প্রাণীর যুগলবন্দি ও মৈথুন (courtship and mating), খাদ্যান্বেষণ (foraging), অভিপ্রয়ান (migration), বাসা তৈরি(nesting), খাদ্য মজুত (hoarding) গড়ে তােলা ইত্যাদি FAP আচরণের অন্তর্গত। প্রজনন ঋতুতে ময়ূরের পেখম মেলে নাচ তাকে কেউ শেখায়নি বা স্বগােত্রীয় কোন সদস্যকে দেখেও শিখেনি।

বাবুই পাখির বাসা তৈরিতে, মাকড়শার জাল বুননের জন্য কিংবা মৌমাছির সামাজিক আচরণের জন্য কোন শিখনের প্রয়ােজন হয় না। গ্রেল্যাগ হাঁস (greylag goose)মাটির অগভীরে গর্ত করে বাসা তৈরি করে। দৈবাৎ এ বাসা থেকে ডিম গড়িয়ে দূরে সরে গেলে প্রথমে চঞ্চুর সাথে ডিমকে স্পর্শ করে। এরপর চঞ্চুর ভেতরের তল দিয়ে ডিমকে ঠেলতে থাকে। অবশেষে চঞ্চু বাঁকা করে ধাপে ধাপে ডিমকে ঠেলতে ঠেলতে বাসায় স্থাপন করে। এগুলাে সবই জিন নিয়ন্ত্রিত আচরণ যা প্রাণীর কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রে পূর্বানুক্রমিত থাকে।

Leave a Comment