চতুর্থ অধ্যায়ঃ রক্ত ও সংবহনতন্ত্র

সংবহনতন্ত্র

যে তন্ত্রের মাধ্যমে প্রাণিদেহে শ্বসনবায়ু,খাদ্যসার,রেচনপদার্থ, হরমোন ইত্যাদি শারীরবৃত্তীয় উপাদান পরিবাহিত হয় তাকে সংবহনতন্ত্র বলে।

রক্ত সংবহনতন্ত্র

যে তন্ত্রের মাধ্যমে সারাদেহে রক্ত সংবহিত হয় তাকে রক্ত সংবহনতন্ত্র বলে। রক্ত সংবহনতন্ত্র ৩টি প্রধান অংশ নিয়ে গঠিত। এগুলো হলো- ১) রক্ত ২) রক্তনালি ৩) হৃদপিন্ড।

রক্ত

রক্ত এক ধরনের লাল বর্ণের তরল যােজক কলা। রক্তবাহিকার মাধ্যমে রক্ত মানব দেহের সর্বত্র সঞ্চালিত হয়। রক্ত সামান্য ক্ষারীয়। এর pH মাত্রা গড়ে ৭.৩-৭.৪। সজীব রক্তের তাপমাত্রা ৩৬-৩৮° সেলসিয়াস। অজৈব লবণের উপস্থিতিতে রক্ত লবণাক্ত। একজন পূর্ণাঙ্গ মানুষের দেহে গড়ে প্রায় ৫-৬ লিটার রক্ত থাকে,শরীরের মােট ওজনের প্রায় ৮%।

রক্তের উপাদান

মানব দেহের রক্ত প্রধানতঃ রক্তরস ও রক্ত কণিকা নিয়ে গঠিত। স্থিতি অবস্থায় কিছুক্ষণ রাখলে রক্ত দুই স্তরে বিভক্ত হয়ে পড়ে। উপরের হালকা হলুদ বর্ণের প্রায় ৫৫% যে অংশ থাকে তাকে রক্তরস বা প্লাজমা বলে এবং নিচের গাঢ়তর বাঁকি ৪৫% অংশকে রক্ত কণিকা (Blood corpuscles) বলে।

প্রকৃতপক্ষে রক্ত কণিকাগুলাে রক্ত রসে ভাসমান অবস্থায় থাকে এবং লােহিত রক্ত কণিকার উপস্থিতিতে রক্ত লাল দেখায়।

রক্ত এক প্রকার যােজক কলা। এর অন্তঃকোষ মাধ্যমটি তরল, হলুদ বর্ণের জলীয় পদার্থ দ্বারা গঠিত। এ তরল পদার্থকে প্লাজমা বা রক্তরস বলে। এ প্লাজমার মধ্যে রক্তকণিকাগুলাে ভাসমান অবস্থায় থাকে।

রক্তের দুটি উপাদান- (১) রক্তরস এবং (২) রক্ত কণিকা। সমগ্র রক্তের ৫৫% রক্তরস এবং বাকি ৪৫% রক্তকণিকা।

রক্ত কণিকা প্রধানত তিন ধরনের, যথা- লােহিত রক্তকণিকা, শ্বেত রক্তকণিকা এবং অণুচক্রিকা।

রক্তরস(PLASMA)

রক্তের তরল অংশকে প্লাজমা বলে। রক্তরসে প্রায় ১০% জৈব ও অজৈব পদার্থ দ্রবীভূত অবস্থায় থাকে।জৈব পদার্থগুলাে হলাে-খাদ্যসার ( গ্লুকোজ অ্যামাইনাে এসিড, স্নেহ পদার্থ, ভিটামিন ইত্যাদি)। রেচন পদার্থ (ইউরিয়া, ইউরিক এসিড, অ্যামােনিয়া, ক্রিয়েটিনিন ইত্যাদি)। প্রােটিন (ফিব্রিনােজেন, গ্লোবিউলিন, অ্যালবুমিন ইত্যাদি)।
প্রতিরক্ষামূলক দ্রব্যাদি (অ্যান্টিটক্সিন)। এছাড়াও রয়েছে হরমােন, কোলেস্টেরল, বিলিরুবিন ইত্যাদি।

অজৈব পদার্থের মধ্যে রয়েছে- সােডিয়াম, পটাসিয়াম, ক্যালসিয়াম, ক্লোরিন, ম্যাগনেসিয়াম, ফসফরাস, লৌহ, আয়ােডিন,এবং গ্যাসীয় পদার্থ- 0,CO2, N, ইত্যাদি।

রক্তরসের কাজ

  • রক্ত কণিকাসহ রক্তরসে দ্রবীভূত খাদ্যসার দেহের বিভিন্ন অংশে পরিবহন করে।
  • বর্জ্য পদার্থ নির্গত করে রেচনের জন্য বৃক্কে পরিবহন করে।
  • রক্ত জমাট বাঁধার প্রয়ােজনীয় উপাদানগুলাে পরিবহন করে।

রক্ত কণিকা(Blood Corpuscles)

রক্তরসের মধ্যে ছড়ানাে বিভিন্ন রকমের কোষকে রক্ত কণিকা বলে।

রক্ত কণিকাগুলাে প্রধানতঃ তিন রকমের, যথা- (১)লােহিত রক্তকণিকা বা ইরাইথ্রোসাইট, (২) শ্বেত রক্ত কণিকা বা লিউকোসাইট এবং (৩) অণুচক্রিকা বা থ্রম্বােসাইট।

লোহিত রক্তকণিকা (Erythrocytes)

মানবদেহের পরিণত লােহিত রক্ত কণিকা দ্বি-অবতল, চাকতি আকৃতির এবং নিউক্লিয়াস বিহীন। এতে হিমােগ্লোবিন নামক রঞ্জক পদার্থ থাকার কারণে লাল বর্ণের হয়। এজন্য এদের Red Blood Cell বা RBC বলে। লােহিত কণিকা প্রকৃতপক্ষে হিমােগ্লোবিন ভর্তি ভাসমান ব্যাগ এবং চ্যাপ্টা আকৃতির। এ কারণে লােহিত কণিকা তার আকারের পরিমাণ অক্সিজেন পরিবহনে সক্ষম।

লােহিত কণিকাগুলাের বিভাজন হয় না। এ কণিকাগুলাে সার্বক্ষণিক অস্থিমজ্জার ভেতরে উৎপন্ন হয় এবং রক্তরসে চলে আসে। মানুষের লােহিত কণিকার আয়ু প্রায় চার মাস অর্থাৎ ১২০ দিন। অন্যান্য মেরুদণ্ডী প্রাণীর ক্ষেত্রে লােহিত কণিকা প্লিহা-তে সঞ্চিত থাকে। তাৎক্ষণিক প্রয়ােজনে এখান থেকে লােহিত কণিকা রক্তরসে সরবরাহ হয়। আমাদের জীবনের প্রতি মুহূর্তে লােহিত রক্তকণিকা ধ্বংস হয় আবার সমপরিমাণ তৈরি হয়।

মােটামুটি গড় হিসেবে বিভিন্ন বয়সের মানব দেহে প্রতি ঘন মিলিমিটার রক্তে লােহিত কণিকার সংখ্যা হচ্ছে: ভূণ দেহে:৮০-৯০ লাখ, শিশুর দেহে: ৬০-৭০ লাখ, পূর্ণ বয়স্ক পুরুষ দেহে: ৪.৫ – ৫.৫ লাখ এবং পূর্ণ বয়স্ক নারীর দেহে: ৪ – ৫ লাখ।

শ্বেত রক্তকণিকা(Leucocytes)

শ্বেত কণিকার নির্দিষ্ট কোনাে আকার নেই। এগুলাে হিমােগ্লোবিনবিহীন এবং নিউক্লিয়াসযুক্ত বড় আকারের কোষ। শ্বেত কণিকার গড় আয়ু ১-১৫ দিন। হিমােগ্লোবিন না থাকার কারণে এদের শ্বেত রক্তকণিকা বলে।

ইংরেজিতে White Blood Cell বা WBC বলে। রক্তে এদের সংখ্যা RBC-এর তুলনায় অনেক কম। এরা অ্যামিবার মতাে দেহের আকারের পরিবর্তন করে। ফ্যাগােসাইটোসিস প্রক্রিয়ায় জীবাণুকে ধ্বংস করে। রক্ত জালিকার প্রাচীর ভেদ করে টিস্যুর মধ্যে প্রবেশ করতে পারে।

শ্বেত কণিকাগুলাে রক্তরসের মধ্য দিয়ে নিজেরাই চলতে পারে। দেহ বাইরের জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হলে, দ্রুত শ্বেত কণিকার সংখ্যার বৃদ্ধি ঘটে। মানবদেহে প্রতি ঘন মিলিমিটার রক্তে ৪-১০ হাজার শ্বেত রক্তকণিকা থাকে। শিশু ও অসুস্থ মানবদেহে এর সংখ্যা বেড়ে যায়।

প্রকারভেদ গঠনগতভাবে এবং সাইটোপ্লাজমে দানার উপস্থিতি বা অনুপস্থিতি অনুসারে শ্বেত কণিকাকে প্রধানত দু’ভাগে ভাগ করা যায় যথা (ক) অ্যাগ্রানুলােসাইট বা দানাবিহীন এবং (খ) গ্রানুলােসাইট বা দানাযুক্ত

(ক) অ্যাগ্রানুলােসাইট

এ ধরনের শ্বেত কণিকাগুলাের সাইটোপ্লাজম দানাহীন ও স্বচ্ছ। অ্যাগ্রানুলােসাইট শ্বেত কণিকা দুই রকমের। যথা- লিম্ফোসাইট ও মনােসাইট। দেহের লিম্ফনােড, টনসিল, প্লিহা, ইত্যাদি অংশে এরা তৈরি হয়। লিম্ফোসাইটগুলাে ছােট কণিকা। মনােসাইট বড় কণিকা।

লিম্ফোসাইট অ্যান্টিবডি গঠন করে এবং এই অ্যান্টিবডির দ্বারা দেহে প্রবেশ করা রােগ জীবাণুকে ধ্বংস করে। এভাবে দেহে রােগ প্রতিরােধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। মনােসাইট ফ্যাগােসাইটোসিস প্রক্রিয়ায় রােগ জীবাণুকে ধ্বংস করে।

(খ) গ্রানুলােসাইট

এদের সাইটোপ্লাজম সূক্ষ্ম দানাযুক্ত। গ্রানুলােসাইট শ্বেত কণিকাগুলাে নিউক্লিয়াসের আকৃতির ভিত্তিতে তিন প্রকার। যথা- (১) নিউট্রোফিল (২) ইওসিনােফিল ও (৩) বেসােফিল।

নিউট্রোফিল ফ্যাগােসাইটোসিস প্রক্রিয়ায় জীবাণু ভক্ষণ করে। ইওসিনােফিল ও বেসােফিল হিস্টাসিন নামক রাসায়নিক পদার্থ নিঃসৃত করে দেহে এলার্জি প্রতিরােধ করে। বেসােফিল হেপারিন নিঃসৃত করে রক্তকে রক্ত বাহিকার ভেতরে জমাট বাঁধতে বাধা দেয় না।

অণুচক্রিকা (Platelets)

ইংরেজিতে এদেরকে প্লাটিলেট (Platelet) বলে। অণুচিক্রকা আকারে ছােট, বর্তুলাকার ও বর্ণহীন। এরা গুচ্ছাকারে থাকে।

অস্থিমজ্জার মধ্যে অণুচক্রিকা উৎপন্ন হয়। অণুচক্রিকাগুলাের গড় আয়ু ৫-১০ দিন। পরিণত মানবদেহে প্রতি ঘন মিলিমিটার রক্তে অণুচক্রিকার সংখ্যা প্রায় আড়াই লাখ। অণুচক্রিকা রক্ত জমাট বাঁধতে সাহায্য করে।

কোন রক্তবাহী নালির ক্ষতি হলে এরা অনতিবিলম্বে থ্রোম্বােপ্লাষ্টিন নামক এক প্রকার রাসায়নিক দ্রব্য নিঃসরণ করে। যা রক্ত জমাট বাঁধতে সাহায্য করে।

অস্বাভাবিক অবস্থা

রক্ত উপাদানের অস্বাভাবিক অবস্থা মানুষের রক্তের বিভিন্ন উপাদানের তারতম্য ঘটলে যে অবস্থার সৃষ্টি হয়, তাকে রক্তের অস্বাভাবিক অবস্থা বলা হয়। যেমন-

১. অ্যানিমিয়া

লােহিত কণিকার সংখ্যা স্বাভাবিকের তুলনায় কমে যায় অথবা হিমােগ্লোবিনের পরিমাণ স্বাভাবিক অবস্থার তুলনায় কমে যায়।

২. পলিসাইথিমিয়া

লােহিত রক্ত কণিকার সংখ্যা স্বাভাবিকের তুলনায় বৃদ্ধি পায়।

৩. লিউকোসাইটোসিস

শ্বেত কণিকার সংখ্যা স্বাভাবিক অবস্থার মান থেকে বেড়ে যদি ১ ঘন মি.লি. রক্তে ২০,০০০-৩০,০০০ হয়।

৪. লিউকোমিয়া

নিউমােনিয়া, প্লেগ, কলেরা, প্রভৃতি রােগে শ্বেত কণিকার সংখ্যা বেড়ে যায়। কিন্তু যদি শ্বেত কণিকার সংখ্যা অত্যাধিক হারে বেড়ে ১ ঘন মি.লি. রক্তে ৫০,০০০-১,০০০,০০০ হয়, তাহলে তাকে লিউকেমিয়া বা ব্লাড ক্যান্সার বলে।

Leave a Comment