সামাজিক আচরন(Social Behavior)
মানুষ সামাজিক জীব।মানুষ যেমন সামাজিক ভাবে বসবাস করে তেমনি প্রায় সকল জীব জীবনের কোন এক পর্যায়ে যুগলবন্দী হয়ে বসবাস করে । মৌমাছি,উঁই,পিঁপড়া,বোলতা,মাছ,পাখি,হরিন,বানর ইত্যাদি প্রানীর ক্ষেত্রে যুগলবন্দী জীবনযাপন সামাজিক আচরণে উন্নীত হয়েছে।
একই প্রজাতিভুক্ত কিছু প্রাণী বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ কারণে বিশেষ শৃঙ্খলার সাথে একত্রে স্থায়ী ভাবে বসবাস করার ব্যবস্থাকে সমাজবদ্ধতা বলে। প্রাণিজগতের মধ্যে মৌমাছি, পিপড়া, বােলতা, উইপােকা, মাছ, পাখি ও প্রাইমেট স্তন্যপায়ীদের ক্ষেত্রে সমাজবদ্ধতা দেখা যায়। তবে সামাজিক প্রাণী হিসেবে মৌমাছি আমাদের কাছে অধিক পরিচিত।
এলট্রুইজম/Altruism
কতক প্রজাতির প্রাণী সামাজিক আচরণের এক পর্যায়ে স্বজাতীয় অন্য সদস্যদের কল্যাণে নিজেদের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য এমনকি জীবন পর্যন্ত উৎসর্গ করে থাকে। একই প্রজাতির অন্য সদস্যদের প্রতি প্রাণীর এরূপ আচরণকে পরস্পরের প্রতিসহমর্মিতা বা Altruism বলে। ফরাসি দার্শনিক August Comte (1851) সর্বপ্রথম Altruism শব্দটি ব্যবহার করেন।
মৌমাছির পরিচয়
মৌমাছি Arthropoda পর্বের Hymenoptera বর্গের Apis গণভুক্ত প্রাণী। এদের বিস্তৃতি বিশ্বব্যাপী। তবে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন প্রজাতি পাওয়া যায়। বাংলাদেশে তিন প্রজাতির মৌমাছি পাওয়া যায়- যথা- Apis indica, Apis dorsata ও Apis florea। মৌমাছি শুধু সামাজিক প্রাণী নয় বরং এরা চরমভাবে অ্যালটুইস্টিক।
চাকের প্রতিটি সদস্য নিজের স্বার্থ না দেখে অন্য সদস্যদের কল্যাণে কাজ করে যায়। প্রতিটি সদস্য সমাজের জন্য নিবেদিত প্রাণ। এরা নিজের স্বার্থে কোন কাজ করে। মৌমাছিরা সামাজিক রীতিনীতি কঠোরভাবে মেনে চলে। এদের ৫০,০০০ থেকে ১০০,০০০ সদস্য একত্রে কলােনি গঠন করে বাস করে। এদের বাসাকে মৌচাক বলে।
মৌমাছির সামাজিক সংঘটন ও সামাজিক আচরণ
মৌমাছির কলােনিতে তিন জাতের মৌমাছি থাকে। এরা হল- একটি রাণী, কয়েক হাজার কর্মী ও কয়েকশত পুরুষ। মৌমাছিদের শ্রমবণ্টন লক্ষ করা যায়। তিন ধরনের মৌমাছির দৈহিক গঠনে ভিন্নতা দেখা যায়। এদের এরূপ অবস্থাকে বহুরূপতা বলে।
রাণী মৌমাছি
দৈহিক গঠন
একটি মৌচাকে মাত্র একটি রাণী মৌমাছি থাকে। রাণী মৌমাছি আকারে অনেক বড়। এদের উদর বেশ প্রশস্ত। এদের ডানাগুলাে ছােট এবং উদরের শেষ প্রান্ত ক্রমশঃ সরু। এ সরু প্রান্তে বাঁকানাে হুল থাকে যা রূপান্তরিত ওভিপজিটর। এদের প্রােবােসিস ও রেণুথলি থাকে না, পদ ক্ষুদ্রাকৃতির, ম্যান্ডিবল বা চোয়াল তীক্ষ্ম, মােম ও মধু সৃষ্টি করতে পারে না, লালাগ্রন্থি নেই।
সামাজিক আচরণ
রাণী মৌমাছি অধিকাংশ সময় মৌচাকের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। কেবল সঙ্গম উড্ডয়নের সময় মৌচাক থেকে বের হয়ে আসে। এরা জীবনে একবার কয়েকশত পুরুষের সাথে সঙ্গমে অংশগ্রহণ করে অসংখ্য শুক্রাণু গ্রহণ করে যা সারা জীবন ডিম্বাণুকে নিষিক্ত করে। রাণী সঙ্গম উড্ডয়নে ব্যর্থ হলে নতুন কলােনি সৃষ্টি হয় না বা পূর্বের কলােনি নষ্ট হয়। সঙ্গমের পর রাণী মৌমাছি প্রতিদিন প্রায় ১৫০০-২০০০ ডিম পাড়ে। সকল ডিম নিষিক্ত হয় না। নিষিক্ত ডিম থেকে স্ত্রী এবং অনিষিক্ত ডিম থেকে পুরুষ মৌমাছি সৃষ্টি হয়। রাণী মৌমাছি ৩-৫ বছর বাঁচে।
রাণী মৌমাছির উৎপত্তি
রাণী মরে গেলে কিংবা প্রজননে অক্ষম হলে কর্মীরা বিকাশরত লার্ভাকে বিশেষভাবে তৈরি রাজকীয় জেলি খাওয়ায়ে কলােনিতে ১৬ দিনের মধ্যে নতুন রাণী সৃষ্টি করে। এ ঘটনাকে সুপার সিডিওর বলে। নতুন রাণী বের হয়ে মৌচাকে বিকাশরত অন্যান্য রাণীদের হুল ফুটিয়ে হত্যা করে। একই সময়ে দুটি রাণী বের হলে এরা মরণ যুদ্ধে লিপ্ত হয়। যুদ্ধে জয়ী রাণী কলােনির সার্বিক দায়িত্বভার গ্রহণ করে।
রাণী মৌমাছির কাজ
রাণী মৌমাছি কলােনিতে একমাত্র প্রজননক্ষম স্ত্রী মৌমাছি। এরা ডিম পাড়ে এবং কলােনীর প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করে। জীবদ্দশায় একটি রাণী মৌমাছি প্রায় দেড় লক্ষ ডিম পাড়ে। রাণী মৌমাছি কলােনির স্বার্থে কঠোরভাবে প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করে। এরা কখনােই কলােনি ত্যাগ করে না। এরা অবিরাম বাচ্চা উৎপাদন করে কলােনির আকৃতি সমৃদ্ধ করে। রাণী মৌমাছির মস্তক থেকে ক্ষরিত ফেরােমন মৌচাকের বিভিন্ন সদস্যদের সংঘবদ্ধ রাখতে সাহায্য করে।
পুরুষ মৌমাছি
দৈহিক গঠন
পুরুষ বা ড্রোন কলােনির প্রজননক্ষম পুরুষ মৌমাছি। কলােনিতে ৩০০-৩০০০ পর্যন্ত ড্রোন থাকে। এরা রাণী অপেক্ষা আকারে কিছুটা ছােট, প্রশস্ত দেহ, বৃহৎ চক্ষু, ক্ষুদ্রাকার তীক্ষ্ম চোয়ালবিশিষ্ট হয়ে থাকে। এদের মােমগ্রন্থি, মধু সংগ্রহকারী যন্ত্র ও হুল থাকে না কিংবা মুখােপাঙ্গ খাদ্য সংগ্রহের উপযােগী নয়।
সামাজিক আচরণ
এরা মৌচাকের অলস প্রকৃতির ও কোলাহল সৃষ্টিকারী সদস্য। এরা প্রতিরক্ষা বা খাদ্য সংগ্রহের কাজে অংশগ্রহণ করে না। এরা এমন অলস প্রকৃতির যে নিজের খাদ্য নিজে গ্রহণ করে না। কোন কারণে কর্মী মৌমাছি না খাওয়ালে এরা মারা যায়।
পুরুষ মৌমাছির উৎপত্তি
অনিষিক্ত ডিম থেকে পার্থেনােজেনেসিস প্রক্রিয়ায় পুরুষ মৌমাছি সৃষ্টি হয়। তাই এরা হ্যাপ্লয়েড (n) প্রকৃতির হয়ে থাকে।
পুরুষ মৌমাছির কাজ
পরিণত পতঙ্গে রূপান্তরিত হওয়ার ১০ দিন পর এরা রাণীকে নিষিক্ত করতে সক্ষম হয়। প্রায় ৫০০০ পুরুষ বৈবাহিক উডডয়নে অংশগ্রহণ করে। যৌনমিলন ছাড়া পুরুষ মৌমাছির অন্য কোন কাজ নেই বললেই চলে। এরা জীবনে কেবল একবার রাণী মৌমাছির সাথে যৌন মিলনের আকাঙ্খায় অপেক্ষা করে এবং মিলনের পর মৃত্যুবরণ করে। প্রজাতির বংশ রক্ষার্থে পুরুষের এরকম আত্মত্যাগ অ্যাটুইজমই প্রকাশ করে।
কর্মী মৌমাছি
দৈহিক গঠন
কর্মী মৌমাছি কলােনির মধ্যে সবচেয়ে ছােট আকারের মৌমাছি। এরা বন্ধ্যা স্ত্রী জাতীয় মৌমাছি। এরা কালাে বা বাদামী বর্ণের হয়ে থাকে। এদের দেহ ও পা ঘন সন্নিবিষ্ট লােম বা ব্রিসল দ্বারা আবৃত থাকে। এদের মুখােপাঙ্গ চর্বণ ও লেহন উপযােগী। এদের উদরের শেষ প্রান্তে একটি হুল থাকে। এদের পশ্চাৎ বক্ষে বিদ্যমান পদে রেণু থলি ও রেণু চিরুণী থাকে। এদের উদরের অঙ্কীয় দিকে একটি মােমগ্রন্থি বিদ্যমান থাকে।
কর্মী মৌমাছির উৎপত্তি
একটি মৌচাকে কর্মী মৌমাছির সংখ্যা ৬০,০০০ থেকে ৮০,০০০ পর্যন্ত হয়ে থাকে। নিষিক্ত ডিম থেকে উৎপন্ন হলেও এরা জননে অক্ষম। যে সব লার্ভাকে শ্রমিক মৌমাছিরা মৌরুটি সরবরাহ করে তারা পূর্ণাঙ্গ অবস্থায় কর্মী মৌমাছিতে পরিণত হয়। শ্রমিক মৌমাছির হাইপােফ্যারিঞ্জিয়াল গ্রন্থি থেকে ক্ষরিত পদার্থ, মধু ও নেকটারের সঙ্গে মিশে যে মিশ্র খাদ্য সৃষ্টি হয় তাকে মৌরুটি বা বি ব্রেড বলে। বৃদ্ধির সপ্তম দিন থেকে এরা মৌচাকের বাইরে আসতে সক্ষম হয়। কেবলমাত্র ২০ দিন বয়সের পরেই নেকটার ও রেণু সংগ্রহ করার জন্য এদের উড্ডয়ন শুরু হয়। এরা প্রায় ৬ সপ্তাহ বেঁচে থাকতে পারে।
সামাজিক আচরণ
এরা মূলত মৌচাকের পরিচ্ছন্নতা, বাচচার যত্ন নেয়া, খাদ্য অন্বেষণ ইত্যাদি কাজ সম্পন্ন করে। খাদ্য অন্বেষণকারী মৌমাছি মৌচাকের নিকটে দু’ধরনের নৃত্য (বৃত্তাকার নৃত্য ও ওয়াগটেল নৃত্য) প্রদর্শন করে অন্যান্য মৌমাছিদের খাদ্যের উৎস সম্পর্কে অবগত করে। বিজ্ঞানী কার্ল ভন ফ্রিস (Karl von Frisch) মৌমাছির নৃত্যের গতি- প্রকৃতি সম্পর্কে প্রথম আলােকপাত করেন। এজন্য এ বিজ্ঞানীকে ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে নােবেল পুরস্কার প্রদান করা হয়।
কর্মী মৌমাছির কাজ
১। মৌচাক পাহারা দেয়া ও অনুপ্রবেশকারীকে আক্রমণ করা। ডানা সঞ্চালন দ্বারা বায়ুপ্রবাহ সৃষ্টি করে মৌচাকের তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা বজায় রাখা। রাণীর পরিচর্যা করা।
২। ব্রুডের বিভিন্ন সদস্যদের যত্ন নেয়া, খাদ্য প্রদান করা, মােম উৎপাদন ও চাক গঠন করা।
৩) খাদ্যের অনুসন্ধান ও অন্যান্য সদস্যদের কাছে তার অবস্থানগত সংকেত প্রদান করা।
৪) নেকটার, পানি, রেণু ইত্যাদির সাহায্যে মধু সৃষ্টি করা।
৫) পরিস্থিতি অনুযায়ী অন্য কর্মী মৌমাছিকে হত্যা করা।
৬) প্রােপােলিস উৎপাদন করা। প্রােপােলিস হলাে রেজিন ও ব্যালসাম (৫০%), মােম (৩০%), তৈল (১০%) ও নেকটার (৫%) গঠিত এক ধরনের জৈব যৌগ যা উদ্ভিদ থেকে সংগৃহীত হয়। এগুলাে মৌচাকের ফাটল ও ছিদ্র মেরামতের কাজে ব্যবহৃত হয়।
৬) কর্মী মৌমাছির মধ্যে অ্যাটুইজম সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। এরা আমৃত্যু কলােনির স্বার্থে কাজ করে।
৭) কলােনি শক্র দ্বারা আক্রান্ত হলে এরা শত্রুর দেহে হুল ফুটিয়ে প্রতিহত করার চেষ্টা করে। একটি কর্মী মৌমাছি জীবনে একবারই হুল ফুটাতে পারে এবং এরপর মারা যায়। অর্থাৎ এরা কলােনির স্বার্থে জীবন উৎসর্গ করে।
৮) এরা কোন ছোঁয়াচে জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হলে কিংবা কোন সংক্রমণ উপযােগী জীবাণু বহন করলে কলােনির স্বার্থে কলােনি ত্যাগ করে একাকী জীবন যাপন করে।
মৌমাছির ঝাঁক বাঁধা বা সােয়ার্মি (Swarming)
নতুন কলােনি সৃষ্টি করার লক্ষ্যে যে পদ্ধতিতে মৌমাছি প্রাকৃতিকভাবে প্রজাতির সংখ্যাকে বৃদ্ধি করার জন্য মৌচাক থেকে দলবদ্ধভাবে বেরিয়ে আসে তাকে ঝক বাধা বলে। মৌমাছির ঝাঁক বাঁধার প্রধান শর্তগুলাে হলাে-
১) যখন রাণী ডিম পাড়তে অসমর্থ হয় বা বন্ধ্যা হয়।
২) যখন শ্রমিক মৌমাছির সংখ্যা অত্যাধিক হয়।
৩) যখন মৌচাকের বায়ু চলাচলে বিঘ্ন ঘটে।
৪) যখন অতিরিক্ত খাদ্যের প্রয়ােজন হয়।
৫) যখন শক্র বা প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষা পাওয়ার প্রয়ােজন পড়ে।