দ্বিতীয় প্রতিরক্ষা স্তর
শ্বেত রক্তকণিকা থেকে উৎপন্ন বিভিন্ন ধরনের ফ্যাগােসাইটিক কোষ (ম্যাক্রোফেজ, নিউট্রোফিল ইত্যাদি), প্রদাহ সৃষ্টিকারী সাড়া (inflammatory response) ও দেহের তাপমাত্রা বৃদ্ধি প্রভৃতি দেহে দ্বিতীয় স্তরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তােলে।
ফ্যাগােসাইটিক কোষ
দেহের প্রথম স্তরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কোনাে কারণে অকার্যকর হয়ে পড়লে ব্যাকটেরিয়া ত্বকের ক্ষতস্থান দিয়ে দেহে প্রবেশের সুযােগ পায়। এক্ষেত্রে ক্ষতস্থানের সূক্ষ্ম রক্তনালিকাগুলাের প্রসারণের ফলে রক্ত প্রবাহ বৃদ্ধি পায়। কৈশিক জালিকার ভেদ্যতা বৃদ্ধির ফলে ফ্যাগােসাইটগুলাে (ম্যাক্রোফেজ, নিউট্রোফিল, মনােসাইট ইত্যাদি) আন্তঃকোষীয় ফাঁকে বের হয়ে আসে এবং অনুপ্রবেশকৃত ব্যাকটেরিয়াকে গলাধঃকরণ করে।
প্রদাহ সৃষ্টিকারী সাড়া
সংক্রমিত স্থানে উৎপন্ন পুঁজ (pus) হচ্ছে রক্তরসে অবস্থিত মৃত কোষ, নিষ্ক্রিয় ব্যাকটেরিয়া ও ফ্যাগােসাইটের মধ্যে সংঘর্ষের ফলে সৃষ্ট ধ্বংসাবশেষ।
ফ্যাগােসাইটোসিসের (phagocytosis) পরিণতি প্রকাশ পায় যখন সংক্রমণের স্থানটি গাঢ় লাল বর্ণের হয়ে স্ফীত হয়। রক্ত প্রবাহ বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে ত্বকের ওই অঞ্চলে লালচে ভাব ফুটে ওঠে। ফ্যাগােসাইট লসিকা গ্রন্থিতে ব্যাকটেরিয়াগুলােকে গলাধঃকরণের মাধ্যমে নিষ্কাষিত করে।
লিম্ফোসাইট ও ক্ষতিগ্রস্থ কলা নিঃসৃত হিস্টামিন (histamin) এর প্রভাবে রক্তের কৈশিক জালিকা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় এবং প্রদাহ সৃজনক্ষম প্রতিক্রিয়া (inflammatory response) দেখা যায়।
দেহের তাপমাত্রা বৃদ্ধি
বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেহের বৃদ্ধিপ্রাপ্ত তাপমাত্রা হচ্ছে অণুজীব ও শ্বেতকণিকার মধ্যকার সংঘর্ষের বহিঃপ্রকাশ। এ ধরনের প্রদাহ অধিকতর বিস্তৃত এবং একে Systemic reaction বলে।
উচ্চ তাপমাত্রার জ্বর শুধু জীবাণুর বৃদ্ধিকে প্রতিহত করে তা নয়, কখনাে কখনাে এরা আসলে দেহের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকেও ক্রিয়াশীল করে তােলে বটে, অবশ্য যদি না তা অতিরিক্ত পর্যায়ের অসুবিধা ঘটায়।
এক্ষেত্রে দুটি কারণে জ্বর হয়ে থাকে। প্রথমত রােগ সৃষ্টিকারী অণুজীব দ্বারা নিঃসৃত বিষক্রিয়া, দ্বিতীয়ত পাইরােজেন নামক রাসায়নিক পদার্থ (fever producing substance) যা শ্বেতকণিকা থেকে নিঃসৃত হয়ে থাকে।
ব্যাকটেরিয়া ধ্বংসে ম্যাক্রোফেজ ও নিউট্রোফিলসের ভূমিকা
মাক্রোফেজ (Macrophage)
ম্যাক্রোফেজ বিশেষ প্রকার শ্বেতকণিকা, যা মনােসাইট (monocyte) থেকে উৎপন্ন হয়। মনােসাইট রক্তের বাইরে বৃহদাকার ধারণ করে ম্যাক্রোফেজে পরিণত হয়।
রেটিকিউলাে এন্ডােথেলিয়াল সিস্টেম (Reticulo-endothelial system) বা মনােনিউক্লিয়ার ফ্যাগােসাইট সিস্টেমের (Mononuclear phagocyte system) ভিতর (যেমন- অস্থিমজ্জা, যকৃৎ, প্লিহা, লিম্ফ নােড ও সাইনাসের ভিতর) ম্যাক্রোফেজ ঘুরে বেড়ায়।
এমনকি ভ্রাম্যমাণ কোষ (wandering cells) হিসেবেও এরা কলার ভিতর বিচরণ করতে পারে। যেমন- কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের ভিতর মাইক্রোগ্লিয়া (microglia), যকৃৎ রক্তনালির ভিতর কুফার কোষ (Kuffer cell), যােজক কলার মধ্যে আবদ্ধ হিস্টিওসাইট বিভিন্ন প্রকার ম্যাক্রোফেজ।
এধরনের কোষ, জীবাণুকে ফ্যাগােসাইটোসিস (phagocytosis) পদ্ধতিতে আত্মসাৎ করে জীবাণু ধ্বংস করতে পারে।
এটা ছাড়াও B ও T লিম্ফোসাইটকে উদ্বুদ্ধ করে অনাক্রম্যতামূলক সক্রিয়তা সৃষ্টি করতেও সক্ষম। এ কারণে ম্যাক্রোফেজকে ইমিউনিটি সৃষ্টির প্রাথমিক উপাদান হিসেবে গণ্য করা হয়।ম্যাক্রোফেজগুলাে প্রাথমিকভাবে দেহে প্রবিষ্ট জীবাণুকে ভক্ষণ করে ধ্বংস করে। তা ছাড়াও ইমিউনিটি সৃষ্টিতে এরা বিশেষ ভূমিকা পালন করে।
দেহত্বক ভেদ করে রােগ জীবাণু কোষ কলায় পৌঁছানাে মাত্রই প্রতিক্রিয়া হিসেবে সেখানে প্রদাহ সৃষ্টি হয়। ফলে দেহের বিভিন্ন জায়গা থেকে ধীরে ধীরে উক্ত প্রদাহস্থলে ম্যাক্রোফেজ এসে জড়াে হতে থাকে।
ম্যাক্রোফেজ কর্তৃক উৎপাদিত প্রােটিন দু’ভাবে ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণ প্রতিহত করে। যেমন-
(ক) ভৌত পদ্ধতিতে
ম্যাক্রোফেজ ব্যাকটেরিয়ার দেহ প্রাচীরে গর্ত বা ছিদ্র করে ব্যাকটেরিয়াকে মেরে ফেলে।
(খ) ফ্যাগােসাইটোসিস প্রক্রিয়ায়
যে প্রক্রিয়ায় শ্বেত রক্ত কণিকাসমূহ অণুজীব ভক্ষণ করে তাকে ফ্যাগােসাইটোসিস বলে।
ম্যাক্রোফেজ ব্যাকটেরিয়ার দেহের বাইরের দিকে আঠার মতাে লেগে থেকে অন্যান্য ম্যাক্রোফেজকে ফ্যাগােসাইটোসিসের জন্য আহ্বান জানাতে থাকে।
ম্যাক্রোফেজ কর্তৃক ফ্যাগােসাইটোসিস প্রক্রিয়ায় ব্যাকটেরিয়া বা জীবাণু নিধন চারটি পর্যায়ক্রমিক ধাপে সম্পন্ন হয়।
১. কেমােট্যাক্সিস: প্রথমে ম্যাক্রোফেজ কেমােট্যাক্সিস প্রক্রিয়ায় ধীরে ধীরে আক্রান্ত স্থানে উপস্থিত হয়।
২. সংলগ্নীকরণ: অতঃপর ব্যাকটেরিয়া ও ম্যাক্রোফেজ নিকটবর্তী হয়ে পাশাপাশি অবস্থান করে। একে সংলগ্নীকরণ বলা হয়। ম্যাক্রোফেজের প্লাজমা আবরণীর কিছু রাসায়নিক গ্রাহক পদার্থ অণুজীবদের সাথে সংযুক্ত হয়ে ফ্যাগােসাইটিক প্রক্রিয়া শুরু করে।
৩. গ্রাসকরণ: ফ্যাগােসাইটোসিস প্রক্রিয়ায় ম্যাক্রোফেজ ব্যাকটেরিয়া বা অন্যান্য রােগ জীবাণুকে দেহাভ্যন্তরে টেনে নেয় বা গ্রাস করে। অর্থাৎ এ সময়ে ম্যাক্রোফেজ অণুজীবের চারদিকে ক্ষণপদ সৃষ্টি করে এটিকে ঘিরে ফেলে এবং পরিশেষে ইনভ্যাজিনেশন প্রক্রিয়া সাইটোপ্লাজমের ভিতরে নিয়ে আসে।
এ প্রক্রিয়াকে ইনজেশন বা গ্রাসকরণ বা ভক্ষণ বলে।দেহাভ্যন্তরে প্রবেশের পর জীবাণুর এ দশাকে ফ্যাগােসসাম (phagosome) বলে।
৪. হত্যা ও পরিপাক: ফ্যাগােসােম ম্যাক্রোফেজের সাইটোপ্লাজমে উপস্থিত লাইসােজাইম (lyoZyme) এনজাইমের সঙ্গে যুক্ত হয়ে ফ্যাগােলাইসােজোম (phagolysome) তৈরি করে।
ফ্যাগােলাইসােজোম তৈরি হওয়ায় ১০-৩০ মিনিটের মধ্যে উক্ত এনজাইমের প্রভাবে ব্যাকটেরিয়ার মৃত্যু ঘটে। অতঃপর মৃত ব্যাকটেরিয়ার অন্তঃকোষীয় পরিপাক (যেমন-লাইসােজাইম, লাইপেজ, নিউক্লিয়েজ ও গ্লাইকোলাইসিস প্রভৃতির ক্রিয়ার পরিপাক) সম্পন্ন হয় এবং অপাচ্য অংশ বাইরে নিষ্ক্রান্ত হয়।
ম্যাক্রোফেজের ইমিউনিটিতে সাড়াদান ফ্যাগােসাইটোসিস প্রক্রিয়ায় জীবাণু ভক্ষণ ছাড়াও ম্যাক্রোফেজ B ও T লিম্ফোসাইটকে উদ্বুদ্ধ করে ইমিউনিটি মূলক সক্রিয়তা সৃষ্টি করতে সক্ষম।
এ কারণে ম্যাক্রোফেজকে ইমিউনিটি সৃষ্টির প্রাথমিক উপাদান হিসেবে গণ্য করা হয়। আমাদের দেহের প্রতিটি কোষের প্লাজমা পদায় MHC (Major Histocompatibility Complex) নামক প্রােটিন থাকে। ম্যাক্রোফেজ নিজের MHC প্রােটিনের দেহের অন্যান্য কোষের MHC প্রােটিনের তুলনা সাপেক্ষে আপন কোষগুলােকে শনাক্ত করতে পারে।
বহিরাগত কোনাে জীবাণু দেহে প্রবেশ করলে প্রােটিনের উপস্থিত সাপেক্ষে ম্যাক্রোফেজ তাদের চিনতে পারে। ভাইরাস ও অন্যান্য বহিরাগত বিষাক্ত পদার্থও এদের দ্বারা চিহ্নিত হয়।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, MHC প্রােটিন MHC জিন দ্বারা সংশ্লেষিত হয় এবং আঙুলের ছাপের মতাে একজনের MHC প্রােটিনের সঙ্গে অপরের প্রােটিনের কোনাে মিল পাওয়া যায়।বহিরাগত জীবাণু, পরজীবী কোষ বা ভাইরাস প্রভৃতি ম্যাক্রোফেজের সংস্পর্শে এলে ম্যাকোফেজ হতে ইন্টারলিউকিন-1 (interleukin-1) নামক প্রােটিন নিঃসৃত হয় এবং উহার প্রভাবে লিম্ফোসাইট কোষগুলাে উদ্বুদ্ধ হয়ে অনাক্রম্যতাজনিত সাড়া জাগায়।
এছাড়া ম্যাক্রোফেজ কর্তৃক ভক্ষিত হয়ে জীবাণু পাচিত হলে উহার কিছু প্রােটিন (অ্যান্টিজেন) ম্যাক্রোফেজের প্লাজমা পদায় MHC প্রােটিনের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে বাইরে উন্মুক্ত হয়। এ অবস্থায় এটি লিম্ফোসাইট কর্তৃক চিহ্নিত হয় ও সক্রিয় হয়ে ওঠে।
নিউট্রোফিলস ইমিউনিটিতে সাড়াদান নিউট্রোফিল মানবদেহের সহজাত রােগ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার এক অত্যাবশ্যকীয় অংশ। মানুষের রক্তে যে শ্বেত রক্তকণিকা সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায় তা হলাে নিউট্রোফিল (৬০-৭০%)।
নিউট্রোফিল প্রধাণত তিন ধরনের প্রক্রিয়ায় ব্যাকটেরিয়া নিধন করে।যথা-
১। ফ্যাগােসাইটোসিস প্রক্রিয়ায়
ফ্যাগােসাইটোসিস পদ্ধতিতে ফ্যাগােসাইটিক নিউট্রোফিলস কলাকোষের মধ্য দিয়ে দেহের যেকোনাে অংশে প্রবেশ করতে পারে এবং ফ্যাগােসাইটোসিস পদ্ধতিতে ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস করে।
এ কাজে লিম্ফোসাইট থেকে নিঃসৃত হরমােন সূদশ রাসায়নিক পদার্থ, যেমন- ইন্টারলিউকিন, লিউকোট্রিন প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এসব রাসায়নিক পদার্থকে সাইটোকাইনস (cytokines) বলে। সাইটোকাইনসের প্রভাবে রক্ত নালিকা প্রসারিত ও ছিদ্রময় হয়ে ওঠে।
ফলে নিউট্রোফিল এসব ছিদ্র দিয়ে রক্ত জালিকায় অন্তরাবরণীয় আস্তরণের যেকোনাে একটি সংযােগস্থলের মধ্য দিয়ে এ কোষগুলাে মুহূর্তে তাদের প্রােটোপ্লাজমীয় ক্ষণপদ (pesudopodium) প্রবেশ করিয়ে দেয় এবং প্রােটোপ্লাজমের অর্ধতরল পদার্থকে ক্ষণপদের দিকে ঠেলে দিয়ে ইচ্ছাকৃতভাবে নিষ্ক্রান্ত হয়।
এ পদ্ধতিতে খুব কম সময়ের (প্রায় ১মিনিট) মধ্যেই অসংখ্য রক্ত কণিকা রক্ত প্রবাহ থেকে বেরিয়ে আসতে পারে। দেহের যে অংশে ব্যাকটেরিয়া প্রবেশে করে সেখানে পৌছেই তারা বিপদাপন্ন অঞ্চলকে ঘিরে ফেলে এবং ব্যাকটেরিয়াকে ধ্বংস করতে শুরু করে।
প্রতিটি কোষ প্রায় ১৫-২০টি রােগ জীবাণু গ্রাস করতে সক্ষম। এদের জীবন্ত অবস্থায়ই তারা গ্রাস করে।
২। প্রােটিওলাইটিক এনজাইম দ্বারা
ফ্যাগােসাইটোসিস পদ্ধতিতে ব্যাকটেরিয়া ছাড়াও নিউট্রোফিল প্রােটিওলাইটিক এনজাইম (যেমন- লেকটোফেরিন, লাইসােজাইম, কোলাজিনেজ, ক্যাথিলিসিডিন ইত্যাদি) নিঃসরণ করে যা ফ্যাগােসাইটোসিস প্রক্রিয়ায় গিলে ফেলা জীবাণুর (ফ্যাগােসােম) সঙ্গে মিশে গিয়ে ফ্যাগােলাইসােজোম তৈরি হয়, যেখানে রােগজীবাণু মারা পড়ে বা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়।
৩। ভৌত পদ্ধতিতে
এ পদ্ধতিতে নিউট্রোফিল রক্ত নালির মধ্যে DNA গঠনের অনুরূপ জালকাকৃতির এক ধরনের বহিঃকোষীয় ফাঁদ (Neutrophil Extracellular Traps-NETs) তৈরি করে ব্যাকটেরিয়াকে নিধন করে।
নিউট্রোফিল,প্রােটিন (সিরাইন প্রােটিয়েজ) ও ক্রোমাটিনের সমন্বয়ে গঠিত উক্ত জালে ব্যাকটেরিয়া আটকা পড়ার পর সেখানেই তাদের মৃত্যু ঘটে। অর্থাৎ এ পদ্ধতি ভৌত উপায়ে ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণ প্রতিহত করে।