আচরণ পরিবর্তনে হরমােনের প্রভাব
মানবদেহে যেকোনাে আচরণের রহস্য উৎঘাটনে বিস্মিত হতে হয় যখন দেখা যায় যে, নিখুঁত, সঠিক ও পরিমিত হরমােনের মিশ্রণে দেহ পরিচালিত হচ্ছে।
এর জন্যে রয়েছে কতকগুলাে সুনির্দিষ্ট অন্তঃক্ষরা গ্রন্থি। জীবনে প্রত্যেক ধাপে বিভিন্ন উপায়ে নারী, পুরুষ ও শিশু দেহের দৈহিক ও মানসিক পরিবর্তনে হরমােনের প্রভাব রয়েছে।
হরমােনের প্রভাবে নারী দেহে আচরণগত পরিবর্তন
রজঃচক্র কালীন আচরণগত পরিবর্তন
রজঃচক্রের সময় কিছু হরমােনের (যেমন- ফলিকল উদ্দীপক হরমােন, লুটিনাইজিন হরমােন, এস্ট্রোজেন ও প্রজেস্টেরন ক্ষরণে তারতম্য ঘটে।
এ তারতম্যের ফলে নারীর আচরণে ডিম্ব পাত চক্রের ঘটনাবলী স্পষ্ট বােঝা যায়। গবেষণায় দেখা গেছে যে,ডিম্বপাত আসন্ন হলে নারীর আহার কমে যায়, মিলনের ইচ্ছা বেড়ে যায় এবং পুরুষের সামনে নিজেকে আকর্ষণীয় করে তুলে ধরে।
উল্লিখিত হরমােনগুলাের ক্ষরণে তারতম্যের জন্য রজঃচক্রকালীন এসব ঘটনা ঘটে থাকে।
গর্ভকালীন আচরণগত পরিবর্তন
গর্ভকালীন আচরণে হরমােনের প্রভাব সুস্পষ্ট। গর্ভধারণের ফলে নারী খাদ্য বিমুখ ও অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ে। কোষ্ঠকাঠিন্য, ঘুম ভাব, বমি ভাব ইত্যাদি দেখা দেয়।
এসব কিছুই ঘটে থাকে হরমােনের বিভিন্ন মাত্রায় ক্ষরণ এবং শিশুর কল্যাণের জন্যই। এ সময় নারী সামান্য রাগে ফেটে পড়ে। অতিরিক্ত হরমােন ক্ষরণে গর্ভবতী নারীর মানসিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটে।
গর্ভকালীন সময়ে এস্ট্রাডিওল নামের এক ধরনের এস্ট্রোজেন জাতীয় হরমােন বিপুল পরিমাণে উৎপন্ন হয়।
এ সময়কার অন্যান্য হরমােনের মধ্যে রয়েছে প্রজেস্টেরন, হিউম্যান কোরিওনিক গােনাডােট্রপিন (Human chorionic gonadotrophin, HCG), রিলাক্সীন প্রভৃতি।
প্রসবােত্তরকালিন আচরণগত পরিবর্তন
সন্তান জন্মদানের সঙ্গে সঙ্গে গর্ভকালীন হরমােনের মাত্রা দ্রুত পড়ে যায়।
হরমােন মাত্রার হঠাৎ নেমে যাওয়ায় কতিপয় নারী অবসাদে ভুগতে পারে। পারিবারিক, সামাজিক ও আর্থিক সমস্যা, কিংবা প্রতিবন্ধী শিশুর জন্ম দেওয়ায় বা স্তন্য দান সংক্রান্ত সমস্যায় নারী প্রচণ্ড মানসিক যন্ত্রণায় ভুগতে পারে।
এর নাম প্রসবােত্তর সাইকোসিস (post-natal psychosis)।
রজঃনিবৃত্তিকালিন আচরণগত পরিবর্তন
পুরুষ অপেক্ষা নারীরা রজঃনিবৃত্ত হওয়ার কয়েক বছর আগে থেকেই বিষন্নতায় ভুগতে থাকে।
রজঃনিবৃত্তির ঠিক পূর্বমুহূর্তে হরমােনের মাত্রা প্রচণ্ড উঠা নামা করে এবং ডিম্বাশয় ক্রমশ প্রজেস্টেরন,এস্ট্রোজেন ও টেস্টোস্টেরন ক্ষরণ কমিয়ে দেয়।
এসব হরমােনের ক্ষরণগত পরিবর্তনে যেসব লক্ষণ দেখা দেয় তা হচ্ছে, হঠাৎ মেজাজ গরম হয়ে যাওয়া, রাতে ঘাম হওয়া, ঘুমে ব্যাঘাত ঘটা, অনিয়মিত রজঃচক্র হওয়া ও যৌনাঙ্গে পরিবর্তন। এসব কারণে অনেক নারী বিষন্নতায় ভুগে থাকে ।
খেলাধুলা কালীন আচরণগত পরিবর্তন
গবেষণায় দেখা গেছে, নারী খেলােয়াড়রা যখন প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ব্যস্ত থাকে তখন তাদের শরীরে টেস্টোস্টেরন হরমােন ক্ষরণ অখেলােয়াড় নারীদের চেয়ে অনেক বেশী হয়। শক্তি যােগাতে, সাহসী ও দৃঢ়চেতা করতে এ হরমােন যথেষ্ট সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
হরমােনের প্রভাবে পুরুষদেহে আচরণগত পরিবর্তন
নারীদের মতাে পুরুষেও হরমােনগত পরিবর্তনের চক্র আবর্তিত হয়। প্রতি ১৫-২০ মিনিটে পুরুষে টেস্টোস্টেরন পরিভ্রমণ করে। এমন সময়কাল মাসিক বা ঋতুভিত্তিকও হতে পারে।
তখন টেস্টোস্টেরণের প্রভাবে পুরুষে যৌনাকাঙ্খা বেড়ে যায়,লিঙ্গত্থান ঘটে, মানসিকতা বা ভাবেরও পরিবর্তন দেখা যায়। ভাবের পরিবর্তন সব সময় এক থাকে না, একদিন থেকে আর একদিন ভিন্ন হয়।
বেশি টেস্টোস্টেরন ক্ষরণে পুরুষ হিংস্র ও উত্তেজিত হয়ে যেতে পারে। তাই বলে পুরুষ আজীবন এতাে শক্তি সামর্থ্য নিয়ে চলতে পারে না। নারীতে যেমন রজঃনিবৃত্তি হয়, তেমনি পুরুষেও হয় শুক্রনিবৃত্তি । এর নাম অ্যান্ড্রোপজ(andropause)।
এ সময় ৪০ বছর বয়স থেকে টেস্টোস্টেরন ক্ষরণ ক্রমশ কমে আসে। ফলে যৌন তাড়না কমে যায়,অবসাধ্বস্ত বা বিষন্নতায় আচ্ছন্ন হতে থাকে। তখন চারপাশের ঘটনা নিয়ে পুরুষ তেমন মাথা ঘামাতে চায় না।
এ নিয়ে চিন্তার কিছু নেই, বয়স হলে সবার এমন হয় ।
হরমােনের প্রভাবে শিশুদেহে আচরণগত পরিবর্তন
শিশু যখন বয়ঃসন্ধিকালীন অবস্থায় উপনীত হয় তখন হরমােনের আচরণগত প্রভাব স্পষ্ট হয়।
অনিয়ন্ত্রিত হরমােন ব্যবহারের ফলাফল (Result of uncontrolled use of hormone)
দেহ সচল, কর্মক্ষম রাখতে অতি অল্প ও নির্দিষ্ট পরিমাণ হরমােন দেহে প্রয়ােজন হয়। কারও দেহে পরিমিত হরমােন ক্ষরিত না হলে নানা জটিল অবস্থা দেখা দিয়ে জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলতে পারে।
এমন অবস্থায় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ ও দক্ষ ব্যবস্থাপনায় নির্দিষ্ট হরমােন ব্যবহার করতে হয়। হরমােনের নিয়ন্ত্রিত ব্যবহার কষ্টদায়ক জীবনের অবসান ঘটালেও অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহারটি উল্টো ফল বয়ে আনে।
নিচে কয়েকটি প্রধান হরমােনের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহারের ফলাফল উল্লেখ করা হলাে –
১। বৃদ্ধি হরমােন
দেহকে স্থিতিশীল ও বৃদ্ধি সাম্য বজায় রাখতে গিয়ে অতিরিক্ত বৃদ্ধি হরমােন ব্যবহারের ফলে উচ্চ রক্তচাপ, রক্তে প্রচুর ফ্যাট, ডায়াবেটিস, সন্ধি ব্যথা , হৃদপিণ্ড বড় হয়ে যাওয়ায় হার্ট ফেইলিউর এবং হাত পা মাথার হাড় অস্বাভাবিক বড় হয়ে যাওয়া।
২। থাইরক্সিন
থাইরক্সিনের স্বল্পতা পূরণে যে সংশ্লেষিত হরমােন ব্যবহার করা হয় তাতে কেবল থাইরয়েড হরমােন স্বল্পতাই পূরণ হয় না, সে সঙ্গে থাইরয়েড ক্যান্সার এবং গলগণ্ড প্রতিরােধেও সহায়ক হয়।
কিন্তু অতিমাত্রায় ব্যবহার হলে যে সব জটিলতা দেখা দেয় তার মধ্যে উল্লেখযােগ্য হচ্ছে: হৃদপিন্ডের ছদ্ম গলগণ্ড হতে পারে, তা ছাড়া দ্রুত হৃদস্পন্দন, পেটে ব্যথা,চিন্তাগ্রস্ততা, খিটখিটে মেজাজ, ওজন কমে যাওয়া, ক্ষুধা বৃদ্ধি প্রভৃতি।
অ্যালারজিক প্রতিক্রিয়ায় শ্বাসকষ্ট, ঘন ঘন শ্বাস নেওয়া এবং মুখমণ্ডল ও জিহ্বা ফুলে যায়। এছাড়াও রক্তে ক্যালসিয়ামের ও ফসফরাসের মাত্রার অস্বাভাবিক পরিবর্তন ঘটে।
৩। এপিনেফ্রিন (অ্যাড্রেনালিন)
ফুসফুসের ভেতরে বাতাস চলাচলের নালি খুলতে, রক্তবাহিকা সংকীর্ণ করতে এবং বিভিন্ন মারাত্মক আলারজিক ক্রিয়ার বিরুদ্ধে কাজ করতে সংশ্লেষিত এপিনেফ্রিন ব্যবহৃত হয়।
অতিমাত্রায় ব্যবহৃত হলে দেখা দেয় উচ্চ রক্তচাপ, সঙ্গে মাথা ব্যথা, ঝাপসা দৃষ্টি, দুশ্চিন্তা, দ্বিধাদ্বন্ধ, বুক ব্যথা, অনিয়মিত হৃদস্পন্দন, হঠাৎ দুর্বলতা, কথা বলা, বা হাঁটাচলায় ভারসাম্যহীনতা, ঘন ঘন শ্বাস নেওয়া প্রভৃতি।
৪। টেস্টোস্টেরন
এটি পুরুষের অত্যন্ত প্রয়ােজনীয় হরমােন। এর স্বাভাবিক ক্ষরণে পুরুষ যৌনাঙ্গ সুগঠিত রাখে, গৌন যৌন বৈশিষ্ট্যের প্রকাশ ঘটিয়ে পৌরুষ প্রদর্শন করে।
বড়ি বা ইনজেকশনের মাধ্যমে টেস্টোস্টেরনের অভাব পূরণে ব্যবস্থা নেওয়া যায়। কিন্তু এর অতিব্যবহারে প্রথমে দুর্বলতা, তন্দ্রালুভাব, গায়ে ব্যথা, চামড়ায় জ্বালা পােড়া ভাব, মনােযােগ হীনতা, হাত পায়ের আঙ্গুল ঠাণ্ডা হয়ে আসা প্রভৃতি দেখা দেয়।
এছাড়াও মন্থর হৃৎস্পন্দন, রক্তময় মলত্যাগ, মূত্রথলিতে ব্যথা, পিঠের দু’পাশে বা মাঝখান ধরে ব্যথা, ডায়রিয়া প্রভৃতি জটিল অবস্থার সৃষ্টি হয়।
৫। এস্ট্রোজেন
এস্ট্রোজেন নারী দেহের গুরুত্বপূর্ণ হরমােন। পরিমিত এস্ট্রোজেন নারী দেহকে সুস্থ সবল ও সুদর্শন রাখে।
কোনও কারণে দেহে অপর্যাপ্ত হরমােন উৎপন্ন হলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক এস্ট্রোজেন বাহী বড়ি বা ইনজেকশন ব্যবহারের পরামর্শ দেন। এসব সামগ্রীর অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহারে নারী বিভিন্ন জটিলতায় ভুগে।
যেমন স্তন দৃঢ় হয়ে যাওয়া,ঢুলুঢুলু ভাব, অতিরিক্ত রক্তস্রাব, মাথা ব্যথা, মানসিক ভাবের পরিবর্তন, বমিভাব, ত্বকে ফুসকুড়ি, মূত্রের রং পরিবর্তন ইত্যাদি।
৬। ইনসুলিন
আজকাল অনেকেই ডায়াবেটিকস আক্রান্ত হয়ে ইনজেকশনের মাধ্যমে ইনসুলিন নিয়ে জীবনযাত্রা অব্যাহত রেখেছেন। কিন্তু এর ব্যবহার কঠিন নিয়ন্ত্রণে না থাকলে নতুন নতুন জটিলতায় ভােগার সম্ভাবনা থাকে।
যেমন অবসাদ,ঢুলুঢুলু ভাব, মাথা ব্যথা, বমিভাব, স্নায়ু দুর্বলতা, ব্যক্তিত্ব পরিবর্তন, দ্রুত হৃদস্পন্দন, ঘুমে ব্যাঘাত, খিচুনি, ত্বক ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া প্রভৃতি।