- শর্করা(কার্বোহাইড্রেট) পরিপাক ও পরিশোষণ
- শর্করাজাতীয় খাদ্য পরিপাকে পরিপাকতন্ত্রের বিভিন্ন অংশের ভূমিকা
- শর্করা জাতীয় খাদ্যের শোষণ
- প্রোটিন বা আমিষ জাতীয় খাদ্যের পরিপাক
- প্রোটিন পরিপাক পদ্ধতি
- লিপিড বা চর্বি জাতীয় খাদ্যের পরিপাক
- চর্বি বা লিপিড পরিপাকে অংশগ্রহনকারী এনজাইম
- লিপিড বা চর্বি জাতীয় খাদ্য পরিপাক পদ্ধতি
- চর্বিজাতীয় খাদ্যের শোষণ
শর্করা(কার্বোহাইড্রেট) পরিপাক ও পরিশোষণ
শর্করা জাতীয় পরিপাকে অংশগ্রহণকারী এনজাইম সমূহঃ
১. লালা রসে টায়ালিন ও মলটেজ।
২. পাকস্থলি রসে: শর্করা পরিপাককারী কোন এনজাইম নেই।
৩. অগ্ন্যাশয় রসে: অ্যামাইলেজ ও মলটেজ।
৪. আন্ত্রিক রসে: অ্যামাইলেজ, মলটেজ, সুক্রেজ, ল্যাকটেজ, আইসােমলটেজ।
শর্করাজাতীয় খাদ্য পরিপাকে পরিপাকতন্ত্রের বিভিন্ন অংশের ভূমিকা
মুখবিবরে শর্করা পরিপাক
মানুষের মুখবিবরে কেবলমাত্র শর্করার পরিপাক ঘটে। মুখবিবরে লালাগ্রন্থি থেকে নিঃসৃত লালারস শর্করা জাতীয় খাদ্য পরিপাকে মূল ভূমিকা পালন করে। লালারসে প্রাপ্ত দুই ধরণের এনজাইম শর্করা পরিপাকে অংশগ্রহন করে।
মিউসিন: মিউসিন খাদ্য বস্তুর সাথে মিশ্রিত হয়ে খাদ্য বস্তুকে নরম ও পিচ্ছিল করে।
টায়ালিন: টায়ালিন এনজাইম প্রধানত ও সিদ্ধ বা রন্ধণকৃত স্টার্চ, গ্লাইকোজেন ও ডেক্সট্রিন অণুকে হাইড্রোলাইসিস করে ক্ষুদ্রতর ডেক্সট্রিন, মলটোজ ও আইসােমলটোজে পরিণত করে।
মলটেজ: মলটেজ এনজাইম সামান্য পরিমাণ মলটোজের উপর ক্রিয়া করে গ্লুকোজে পরিণত করে।
(পাকস্থলিতে অম্লীয় পরিবেশ সৃষ্টি হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত চলতে থাকে)।
পাকস্থলিতে শর্করা পরিপাক (Digestion of carbohydrate in intestine)
কোন এনজাইম নেই তবে পাকস্থলি হতে পাকস্থলির পাচকরসে পরিপাককারী নিঃসৃত HCl কিছু ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস করে এবং কিছু পরিমাণ সুক্রোজকে আর্দ্রবিশ্লিষ্ট করে গ্লুকোজ ও ফ্রুকটোজে পরিণত করে।
HCI+সুক্রোজ = গ্লুকোজ + ফ্রুকটোজ
ক্ষুদ্রান্ত্রে শর্করা পরিপাক (Digestion of carbohydrate in small intestine)
পাকস্থলি থেকে শর্করা জাতীয় খাদ্য ক্ষুদ্রান্ত্রে এলে তা অগ্নাশয় রস ও আন্ত্রিক রসের ক্রিয়ায় পরিপাক হতে থাকে। অগ্ন্যাশয়িক রসের প্রভাবে শর্করা পরিপাককারী এনজাইমগুলাে নিম্নোক্তভাবে খাদ্য পরিপাক করে থাকে। অগ্নাশয়িক অ্যামাইলেজ ক্ষারধর্মী পরিবেশে (ph =7.1) স্টার্চ, গ্লাইকোজেন ও ডেক্সট্রিনকে আর্দ্রবিশ্লিষ্ট করে মলটেজ,আইসােমলটোজ, মলটোট্রোয়ােজ ও লিমিট ডেক্সট্রিনে পরিণত করে।
মলটেজঃ মলটেজ এনজাইম মলটোজের উপর ক্রিয়া করে গ্লুকোজে পরিণত করে।
আন্ত্রিক রসের প্রভাবে শর্করা পরিপাকঃ আন্ত্রিক রসে শর্করা পরিপাককারী নানা ধরনের এনজাইম নিমােক্তভাবে পরিপাক করে থাকে।
আন্ত্রিক অ্যামাইলেজঃ অ্যামাইলেজ+স্টার্চ, গ্লাইকোজেন ও ডেক্সট্রিন= লিমিট ডেক্সট্রিন + মলটোজ + মলটোট্রায়ােজ + আইসােমলটেজ।
আইসােমলটেজঃ আইসােমলটেজ এনজাইম আইসােমলটোজকে আর্দ্রবিশিষ্ট করে মলটোজ ও গ্লুকোজে পরিণত করে। আইসােমলটোজ+আইসােমলটেজ=মলটোজ+ গ্লুকোজ
মলটেজঃ মলটেজ এনজাইম মলটোজের উপর ক্রিয়া করে গ্লুকোজে পরিণত করে।
সুক্রেজঃ সুক্রেজ+সুক্রোজ=গ্লুকোজ + ফুকটোজ ।
ল্যাকটেজঃ দুধের ল্যাকটোজ কে ডেক্সট্রোজ ও গ্লুকোজ এ পরিণত করে।
শর্করা জাতীয় খাদ্যের শোষণ
পরিপাকের ফলে শর্করা থেকে গ্লুকোজ উৎপন্ন হয়ে ক্ষুদ্রান্ত্রের এপিথেলিয়ামের মধ্য দিয়ে রক্তস্রোতে প্রবেশের প্রক্রিয়াকে “পরিশােষণ” বলে।
শর্করা সম্পূর্ণরূপে পাচিত হয়ে বিভিন্ন প্রকার একক শর্করা যেমন- গ্লুকোজ, ফুকটোজ,গ্যালাক্টোজ, লেভুলােজ, ম্যানোজ প্রভৃতিতে পরিণত হয়। এরপর ক্ষুদ্রান্ত্রের ভিলাসের রক্ত জালকের দ্বারা ব্যাপন প্রক্রিয়ায় পরিশােষিত হয় এবং পাের্টাল সংবহনের মাধ্যমে যকৃতে পরিবাহিত হয়। গ্লুকোজ সম্পূর্ণরূপে ক্ষুদ্রান্ত্রের জেজুনামে পরিশােধিত হয়।
প্রোটিন বা আমিষ জাতীয় খাদ্যের পরিপাক
প্রোটিন জাতীয় খাদ্যের পরিপাক শুরু হয় পাকস্থলীতে এবং শেষ হয় ক্ষুদ্রান্ত্রে। প্রোটিন পরিপাকে অংশগ্রহনকারী এনজাইম সমূহঃ পাকস্থলীর এনজাইম ও ক্ষুদ্রান্ত্রের এনজাইম ।
প্রোটিন পরিপাক পদ্ধতি
১. পাকস্থলিতে আমিষ পরিপাক
মুখবিবর থেকে আমিষ জাতীয় খাদ্য পাকস্থলিতে এলে তা পাচক রসের সাথে ক্রিয়া করে পেপসিন ও জিলেটিনেজ এনজাইম এবং HCl দ্বারা প্রভাবিত হয়ে পেপটোন ও প্রােটিওজ এবং কিছু পলিপেপটাইড উৎপন্ন করে।
HCl+নিষ্ক্রিয় পেপসিনােজেন= পেপসিন (সক্রিয়)
সুপাচ্য আমিষ+ পেপসিন= পেপটোন + প্রােটিওজ + পলিপেপটাইড
জিলেটিনােজ+জিলেটিনেজ= পেপটোন + পলিপেপটাইড।
২. ক্ষুদ্রান্ত্রে আমিষ পরিপাক
অধিকাংশ আমিষ পাকস্থলিতে সক্রিয় পেপসিনের প্রভাবে পেপটোনে পরিণত হয়ে ক্ষুদ্রান্ত্রে প্রবেশ করে এবং অগ্ন্যাশয়রস ও আন্ত্রিকরসের সাহায্যে সম্পূর্ণ পাচিত হয়। অগ্ন্যাশয়িক এনজাইমের প্রভাবে আমিষ পরিপাক
ট্রিপসিন: ক্ষারধর্মী পরিবেশে ট্রিপসিন এনজাইম, প্রােটিন, প্রােটিওজ ও পেপটোনের উপর কাজ করে পলিপেপটাইড ও ডাইপেপটাইডে পরিণত করে।
প্রােটিন, প্রােটিওজ, পেপটোন+ট্রিপসিন=পলিপেপটাইড + ডাইপেপটাইড (ক্ষারীয় পরিবেশ)
কাইমােট্রিপসিন: দুধের আমিষ কেসিনকে প্যারাকেসিন এ পরিনত করে।
কাইমােট্রিপসিন+কেসিন (দুধের প্রােটিন)= প্যারাকেসিন + ছানার পানি
কার্বক্সিপেপটাইডেজ এ ও বি: পেপটাইড অণুকে ক্ষুদ্রতর পেপটাইডে পরিণত করে।
পলিপেপটাইড (বৃহৎ)+কার্বক্সিপেপটাইডেজ= ক্ষুদ্রতর পেপটাইড + অ্যামাইনাে এসিড
ইলাস্টেজ: ইলাস্টেজ এনজাইম ইলাস্টিনকে (যােজক কলার আমিষ) ভেঙ্গে ক্ষুদ্রতর পেপটাইড ও অ্যামাইনাে এসিডে পরিণত করে।
ইলাস্টিন+ইলাস্টেজ= ক্ষুদ্রতর পেপটাইড + অ্যামাইনাে এসিড।
কোলাজিনেজ: কোলাজিনেজ এনজাইমের প্রভাবে কোলাজেন (যােজক টিস্যুর আমিষ) ভেঙ্গে ক্ষুদ্রতর পেপটাইড ও অ্যামাইনাে এসিডে পরিণত হয়।
কোলাজিনেজ+কোলাজেন= ক্ষুদ্রতর পেপটাইড + অ্যামাইনাে এসিড।
আন্ত্রিক রসের প্রভাবে আমিষ পরিপাক
আন্ত্রিক রসে আমিষ পরিপাককারী এনজাইমগুলাে নিম্নোক্তভাবে আমিষ পরিপাক করে ।
অ্যামাইনােট্রিপসিন+অ্যামাইনযুক্ত পেপটাইড= অ্যামাইনাে এসিড
ট্রাইপেপটাইড+ট্রাইপেপটাইডেজ= ডাইপেপটাইড + অ্যামাইনাে এসিড
ডাইপেপটাইড+ডাইপেপটাইডেজ= অ্যামাইনাে এসিড
প্রোটিন জাতীয় খাদ্যের শোষণ
খাদ্যের সাথে গৃহীত আমিষগুলাের পরিপাকের ফলে উৎপন্ন অ্যামাইনাে এসিড ক্ষুদ্রান্ত্রের ভিলাই-এর রক্ত জালকের দ্বারা ব্যাপন প্রক্রিয়ায় পরিশােধিত হয় এবং সকল অ্যামাইনাে এসিড প্রধানত পাের্টালতন্ত্রের মাধ্যমে পরিবাহিত হয়। এই অ্যামাইনাে এসিডের প্রধান পরিশােষণ অঞ্চল হচ্ছে ক্ষুদ্রান্ত্রের জেজুনাম।
লিপিড বা চর্বি জাতীয় খাদ্যের পরিপাক
মানুষ দৈনন্দিন জীবনে যে সব চর্বি জাতীয় খাদ্য গ্রহণ করে তা সামান্য পরিমাণ, পরিপাক না হয়ে অপরিবর্তিত অবস্থায় শােষিত হয়। যেমন- তেল, ঘি, মাখন,কোলেস্টেরল, ফসফোলিপিড, ফ্যাটি এসিড ও গ্লিসারল।
চর্বি বা লিপিড পরিপাকে অংশগ্রহনকারী এনজাইম
পাকস্থলি রস বা পাচক রসেঃ লাইপেজ বা ট্রাইবিউটারেজ।
অগ্ন্যাশয় রসেঃ অগ্ন্যাশয় লাইপেজ, ফসফোলাইপেজ ও কোলেস্টেরল এস্টারেজ।
আন্ত্রিক রসেঃ আন্ত্রিক লাইপেজ, মনােগ্লিসারিডেজ, লেসিথিনেজ ইত্যাদি।
লিপিড বা চর্বি জাতীয় খাদ্য পরিপাক পদ্ধতি
পাকস্থলিতে অম্লীয় পরিবেশের জন্য পাকস্থলির লাইপেজ তেমন কাজ করতে পারে না, তবে শিশুর পাকস্থলির অম্লতা বেশি না হওয়ায় বেশ কাজ করে। লাইপেজ অদ্রবীভূত লিপিড কণাকে যেমন- দুধে ভাসমান লিপিড কণা ভেঙ্গে মনােগ্লিসারাইড, ফ্যাটি এসিড ও গ্লিসারলে পরিণত হয়।
লাইপেজ+লিপিড= মনােগ্লিসারাইড + ফ্যাটি এসিড + গ্লিসারল।
ক্ষুদ্রান্ত্রে চর্বি পরিপাক
আন্ত্রিক রসের প্রভাবে চর্বি জাতীয় খাদ্য পরিপাকে নানা ধরনের এনজাইম সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। যেমন-
আন্ত্রিক লাইপেজঃ আন্ত্রিক লাইপেজ পিত্ত লবণের প্রভাবে অদ্রবীভূত লিপিড কণাকে আর্দ্রবিশ্লিষ্ট করে মনােগ্লিসারাইড ও ফ্যাটি এসিডে পরিণত করে। পরে তা গ্লিসারল ও ফ্যাটি এসিডে রূপান্তরিত হয়।
লিপিড+আন্ত্রিক লাইপেজ= মনােগ্লিসারাইড + ফ্যাটি এসিড
লেসিথিনেজঃ আন্ত্রিক রসের লেসিথিনেজ এনজাইম লেসিথিনকে ফ্যাটি এসিড, গ্লিসারল, ফসফরিক এসিড ও কোলিনে পরিণত করে।
লেসিথিন+লেসিথিনেজ= ফ্যাটি এসিড + গ্লিসারল + ফসফরিক এসিড + কোলিন।
মনােগ্লিসারিডেজঃ কোষের ভেতরে মনােগ্লিসারাইডকে ফ্যাটি এসিড ও গ্লিসারলে পরিণত করে।
মনােগ্লিসারাইড+মনােগ্লিসারিডেজ= ফ্যাটি এসিড + গ্লিসারল
অগ্নাশয়িক রসের প্রভাবে চর্বি পরিপাক
অগ্ন্যাশয়িক লাইপেজ: লাইপেজ ট্রাইগ্লিসারাইডকে ভেঙ্গে ফ্যাটি এসিড এবং গ্লিসারলে পরিণত করে।
ট্রাইগ্লিসারাইড+লাইপেজ= গ্লিসারল + ফ্যাটি এসিড
ফসফোলাইপেজ: অগ্নাশয়ের ফসফোলাইপেজ ট্রিপসিনের প্রভাবে সক্রিয় হয়ে লেসিথিন ও ফ্যাটি এসিডের উপর বিক্রিয়া করে লাইসােলেসিথিন ও লাইসােকোলিন উৎপন্ন হয়।
লেসিথিন + কেফালিন ফসফোলাইপেজ= লাইসােলেসিথিন + লাইসােকেফালিন।
কোলেস্টেরল এস্টারেজ: পিত্ত লবণের উপস্থিতিতে সক্রিয় হয়ে খাদ্যের কোলেস্টেরল এস্টারগুলােকে ভেঙ্গে মুক্ত কোলেস্টেরল ও ফ্যাটি এসিডে পরিণত করে।
কোলেস্টেরল এস্টারেজ+কোলেস্টেরল= ফ্যাটি এসিড+কোলেস্টেরল এস্টার
চর্বিজাতীয় খাদ্যের শোষণ
ট্রাইগ্লিসারাইড পরিপাক ছাড়াই ক্ষুদ্রান্ত্রের গহ্বর থেকে আবরণী কোষে প্রবেশ করে এবং লসিকানালিতে পরিশােধিত হয়। ক্ষুদ্রান্ত্র থেকে চর্বি বা স্নেহ বস্তুর পরিশােষণ পাের্টাল শিরার মাধ্যমে এবং ভিলাই এ কেন্দ্রীয় লসিকানালির মাধ্যমে সম্পন্ন হয়। গ্লিসারল ও ফ্যাটি এসিড যেমন- মাখনের চর্বি পাের্টাল শিরার মাধ্যমে শােষিত হয়ে যকৃতে পৌঁছে এবং কোষ পর্দার মাধ্যমে এপিথেলিয়াল কোষে প্রবেশ করে। পরিশেষে ভিলাই-এ রক্ত জালিকায় পরিশােষিত হয়।
কিছু সংখ্যক ফ্যাটি এসিড সরাসরি লসিকানালিতে প্রবেশ করে এবং কোলেস্টেরল এস্টার হিসেবে লসিকানালিতে পরিশােষিত হয়। মানুষের চর্বি জাতীয় খাদ্যের পরিশােষণ মূলত ডিওডেনাম এবং জেজুনামের প্রথম অংশে সম্পন্ন হয়।