পঞ্চম অধ্যায়ঃ শ্বসন ও শ্বসনক্রিয়া

শ্বসন ও শ্বাসক্রিয়া

শ্বসন

যে শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়ায় প্রাণী বিরামহীনভাবে পরিবেশ থেকে অক্সিজেন গ্রহণ করে এবং সে অক্সিজেনের সাহায্যে কোষ মধ্যস্থ সরল খাদ্যকে জারিত করে খাদ্যস্থিত স্থিতিশক্তিকে গতিশক্তিতে রূপান্তর করে এবং এতে উৎপন্ন কার্বন ডাইঅক্সাইডকে দেহ হতে ত্যাগ করে তাকে শ্বসন (Respiration) বলে।

শ্বসনের দু’টি পর্যায় থাকে। যথা- বহিঃশ্বসন (External respiration) ও অন্তঃশ্বসন (Internall respiration)।

বহিঃশ্বসন

ফুসফুসের অ্যালভিওলাসের বায়ুর সাথে ফুসফুসীয় রক্ত জালিকার মধ্যে প্রশ্বাস ও নিশ্বাসের সময় যে গ্যাসীয় আদান প্রদান হয় তাকে বহিঃশ্বসন বলে।

অন্তঃশ্বসন

রক্তের মাধ্যমে অক্সিজেন দেহের কলাকোষে প্রবেশ করে কোষস্থ খাদ্যের সাথে বিক্রিয়া করে শক্তি, কার্বন ডাইঅক্সাইড (CO2) ও পানি উৎপাদন করার প্রক্রিয়াকে অন্তঃশ্বসন বলে।

এতে নিম্নের রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটে।

C6H12O6 + 6O2=6CO2+ 6HO2+ শক্তি (তাপ বা ATP)

শ্বসনতন্ত্র

যে সকল অঙ্গ সম্মিলিতভাবে দেহ ও প্রকৃতির মধ্যে শ্বসন গ্যাস (O, ও CO2) বিনিময় প্রক্রিয়ায় সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে তাদের সমষ্টিকে শ্বসনতন্ত্র বলে। শ্বসনতন্ত্র রক্তে অক্সিজেন সরবরাহ করে এবং বিপাকে সৃষ্ট গ্যাসীয় বর্জ্য বা কার্বনডাইঅক্সাইড অপসারণ করে।

শ্বসনতন্ত্রের বিভিন্ন অংশের গঠন

১। নাসিকা ও নাসাপথ (Nasal apperture)

এটি মুখমণ্ডলের দুটি চোখের মাঝখানে, বাম ও ডান চোয়ালের মধ্যে অবস্থিত। নাসিকায় দুটি বহিঃনাসারন্ধ্র ও নাসা গহ্বর থাকে। নাসাগহ্বর একটি উল্লম্ব ব্যবধায়ক দ্বারা বাম ও ডান নাসাপথে বিভক্ত।নাসাপথ অন্তঃনাসারন্ধ্র নামক দুটি ছিদ্র দিয়ে মুখবিবরে মুক্ত থাকে। খাদ্য গ্রহণের সময় অন্তঃনাসারন্ধ্র দুটি আলজিহ্বা নামক ঢাকনা দিয়ে ঢাকা থাকে। নাসাপথ পিচ্ছিল ও লােমাবৃত থাকে।

কাজ: নাসাপথ দিয়ে বায়ু প্রবেশ করে ঘ্রাণ ও উদ্দীপনা গ্রহণে সহায়তা করে। লােমযুক্ত মিউকাস কোষগুলাে বায়ুর ধূলাবালি ও রােগজীবাণু আটকে দেয়।

২। নাসাগলবিল (Nasopharynx)

নাসিকা গহ্বরের পশ্চাৎ হতে স্বরযন্ত্রের পূর্ব পর্যন্ত বিস্তৃত প্রশস্ত অংশকে নাসাগলবিল বলে।

কাজ: গলবিলে প্রবিষ্ট বাতাস নাসাগলবিল হয়ে ট্রাকিয়াতে পৌছায় এবং খাদ্যগ্রহণকালে আলজিহ্বা ট্রাকিয়ার প্রবেশপথ বন্ধ করে দেয়।

৩। ল্যারিংক্স (Larynx) বা স্বরযন্ত্র

এটি ট্রাকিয়ার অগ্রপ্রান্তে পেশি ও নয়টি কার্টিলেজ দ্বারা গঠিত ত্রিকোণাকৃতির একটি গহ্বর। এ গহবরে ছয়টি ভােকাল কর্ড থাকে। ভােকালকৰ্ড পেশির সাথে যুক্ত। ট্রাকিয়ার পেশি প্রসারিত হলে ভােকালকর্ড ঢিলা ও পৃথক হয়ে যায়। ফলে ফাঁকা স্থানের সৃষ্টি হয় এবং ফুসফুস থেকে বাতাস নিঃশব্দে বের হয়। আবার পেশি সংকুচিত হলে ভােকালকর্ড টানটান হয়ে পরস্পরের কাছাকাছি আসে। ফলে প্রশ্বাসের বাতাস দ্বারা ভােকাল কর্ডে কম্পন সৃষ্টির মাধ্যমে স্বরের সৃষ্টি হয়।

কাজ: স্বরযন্ত্রে স্বর সৃষ্টি হয়।

৪। শ্বাসনালি বা ট্রাকিয়া

ল্যারিংক্সের পশ্চাৎ ভাগ হতে বক্ষগহ্বরের ৫ম কশেরুকা পর্যন্ত বিস্তৃত ফাঁপা নলাকার গঠনটির নাম ট্রাকিয়া। এর প্রাচীর ১৫-২০টি অসম্পূর্ণ তরুনাস্থি বলয় দ্বারা গঠিত। এর অন্তঃগাত্র রােমযুক্ত ঝিল্লি দ্বারা বেষ্টিত ।

কাজ: ইহা চুপসে যায় না বলে এর মধ্য দিয়ে সহজে বায়ু চলাচল করে।

৫। ক্রোমনালি বা ব্রঙ্কাস (Bronchus)

ট্রাকিয়ার শেষ প্রান্ত দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে দুটি ব্রঙ্কাস গঠন করে। দুটি ব্রঙ্কাস দু’টি ফুসফুসে প্রবেশ করে। ফুসফুসের অভ্যন্তরে প্রতিটি ব্রঙ্কাস পুনঃ বিভক্ত হয়ে অসংখ্য ক্ষুদ্রাকার ব্রাঙ্কিওল গঠন করে।

কাজ: ট্রাকিয়া থেকে বাম ও ডান ফুসফুসে বায়ু পরিবহন করে।

৬। ফুসফুস (Lungs)

মানুষের হালকা গােলাপী বর্ণের স্পঞ্জের মত নরম দুটি ফুসফুস থাকে। বাম ফুসফুসটি আকারে ছােট, দুই লােব বিশিষ্ট এবং ডান ফুসফুসটি আকারে বড় ও তিন লােব বিশিষ্ট। ফুসফুস দুইস্তর যুক্ত প্নিউরা পর্দা দ্বারা আবৃত থাকে। ভেতরের পর্দাকে ভিসেরাল প্লিউরা এবং বাইরের পর্দাকে প্যারাইটাল প্লিউরা বলে।

দুই স্তরের মাঝে সেরাস ফুইড (serous fluid) নামক এক ধরনের রস থাকে যা ফুসফুসকে ঘর্ষণজনিত আঘাত থেকে রক্ষা করে। ব্রঙ্কাস যে অংশে ফুসফুসে প্রবেশ করে তাকে হাইলাম বলে।

হাইলামের মাধ্যমে ধমনি ফুসফুসে প্রবেশ করে ব্ৰঙ্কিওল গঠন করে এবং শিরা ও নাসিকা নালী বের হয়ে আসে। ব্রঙ্কাস, ধমনি, ব্রঙ্কিয়া শিরা, নাসিকা নালী ঘন যােজক কলায় পরিবেষ্টিত হয়ে পালমােনারি মূল গঠন করে এবং এর সাহায্যে ফুসফুস ঝুলে থাকে।

কাজ: অ্যালভিওলাসের প্রাচীরের রক্তজালিকা ও ফুসফুস মধ্যস্থ গ্যাসীয় পদার্থের মধ্যে ব্যাপন ঘটে। দেহের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ, পানি সাম্যতা রক্ষা ও শব্দ সৃষ্টিতে সহায়তা করে।

অ্যালভিওলাস (Alveolus)

ফুসফুসের গঠনগত ও কার্যগত একক হলাে অ্যালভিওলাস। অ্যালভিওলাসগুলাে ক্ষুদ্র বুদবুদ সদৃশ বায়ুকুঠুরী বিশেষ। ডান ফুসফুসে ১০টি ও বাম ফুসফুসে ৮টি লােবিউল থাকে। প্রতিটি লােবিউলে ৫০-৮০টি অ্যালভিওলি থাকে।অ্যালভিওলাসের প্রাচীর চ্যাপ্টাকৃতির স্কোয়ামাস এপিথেলিয়াল কোষ দ্বারা গঠিত।

এতে কোলাজেন ও ইলাস্টিন তন্তু থাকে। ফলে শ্বসনের সময় সংকোচন ও প্রসারণ সহজ হয়।এছাড়া অ্যালভিওলার বায়ু ও প্রাচীরের কৈশিক জালিকার রক্তের মধ্যে যে গ্যাসীয় বিনিময় সম্পাদিত হয় তার মধ্যবর্তী বিভেদক পর্দাকে শ্বাসপর্দা বলে। শ্বাসপর্দাটি দুটি কোষীয় স্তর ও দুটি ভিত্তিপর্দা নিয়ে গঠিত।

এদের মধ্যে একটি এপিথেলিয় আবরণী ও অপরটি এন্ডােথেলিয় আবরণী। বায়ু ও রক্তের মধ্যবর্তী স্থানে এই মিহিপর্দার উপস্থিতি গ্যাসীয় বিনিময়কে সহজ করে।

Leave a Comment