গর্ভাবস্থায় বিভিন্ন সমস্যা।গর্ভকালীন বিভিন্ন জটিল সমস্যা

গর্ভাবস্থায় বিভিন্ন সমস্যা

প্রতিবছর গর্ভকালীন বিভিন্ন জটিলতায় আমাদের দেশে বহু নারীর মৃত্যু হয়। গর্ভকালীন বিভিন্ন জটিলতা ও সমস্যা সম্পর্কে অজ্ঞতা ও সচেতনতার অভাবে মা ও শিশু উভয়ের জীবন ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে।

তাই গর্ভকালীন সমস্যা বিষয়ে সচেতনতা ও সঠিক পরিচর্যাই পারে মা ও শিশুর জীবন বাঁচাতে। গর্ভাবস্থায় মায়েদের কিছুসাধারণ সমস্যা ও করণীয় দিকসমূহ নিয়ে নিম্নে আলােচনা করা হলাে-

১। বমি ভাব ও বমি- এটা খুব সাধারণ সমস্যা এবং বলা হয় যে, এটা গর্ভধারণের প্রথম লক্ষণ। সাধারণতঃ হরমােনের তারতম্যের কারণে এমনটি হয়। গর্ভাবস্থায় প্রথম তিন মাস এ সমস্যা দেখা দেয়। বিশেষ করে সকালের দিকে কারাে কারাে ক্ষেত্রে আরও বেশি সময় দেখা দিতে পারে। পরে আপনা আপনি এ সমস্যা দূর হয়। এ নিয়ে দুশ্চিন্তার কিছু নেই। এ সমস্যা সমাধানে করণীয় দিক- ক, যে সব মায়েদের এ সমস্যা দেখা দেয় তাদের সকাল বেলা ঘুম থেকে জেগে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তেলবিহীন শুকনাে খাবার যেমন- মুড়ি, খই, রুটি, বিস্কুট ইত্যাদি খেয়ে কিছুক্ষণ শুয়ে থাকতে হবে।বারবার অল্প করে খেতে হবে।খাবারের অন্ততঃ ৩০ মিনিট পর পানি খেতে হবে। প্রয়ােজনে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।

২। রক্ত স্বল্পতা- অনেক সময় গর্ভাবস্থায় রক্ত স্বল্পতা দেখা দেয়। এ সমস্যা সমাধানে করণীয় দিক- ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী প্রথম মাস থেকে ফলিক এসিড এবং ৩ মাসের পর থেকে আয়রন ও ক্যালসিয়াম ট্যাবলেট খেতে হবে। আয়রনযুক্ত খাবার যেমন- কচু শাক, কলিজা, তেঁতুল, তরমুজ, ডিম ইত্যাদি খেতে হবে। ভিটামিন সি সমৃদ্ধ খাবার যেমন-আমলকি, লেবু, কাঁচামরিচ, পেয়ারা, আনারস এবং কাঁচা ফলমূল খেতে হবে ।

৩। কোষ্ঠকাঠিন্য- গর্ভাবস্থায় কোষ্ঠকাঠিন্যের প্রবণতা থাকে। খাবার গ্রহণ, প্রয়ােজন মতাে পানি পান না করা ও অনিয়মিত পরিশ্রমের ফলে এ ধরনের সমস্যা দেখা দেয়। এ সমস্যা সমাধানে করণীয় দিক- প্রচুর পরিমাণে পানি পান করা।প্রচুর পরিমাণ শাক সবজি ও টাটকা ফল খেতে হবে। যেমন- আম, কলা, গাছ পাকা পেয়ারা, খেজুর, পেঁপে, আপেল ইত্যাদি। এছাড়া দুধ, কলা, রুটি, ভাত খাওয়া যেতে পারে। নিয়মিত ঘরের কাজ ও হাঁটা চলা করতে হবে।প্রয়ােজনে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ইসবগুলের ভুষি খেতে হবে।

৪। গলা ও বুক জ্বালা- গর্ভাবস্থার মাঝামাঝি এবং শেষ দিকে গলা ও বুক জ্বালা একটি সাধারণ সমস্যা। এ সমস্যা সমাধানে করণীয় দিক- ক. সহজপাচ্য খাবার বার বার অল্প করে খেতে হবে, খ. খাওয়ার পরপর শােয়া যাবে না। বেশি প্রয়ােজন হলে মাথার নিচে দুটি বালিশ দিয়ে অর্ধশয়ন অবস্থায় শুতে হবে, গ. মশলাযুক্ত ভাজা খাবার পরিহার করতে হবে, ঘ. প্রচুর পরিমাণ পানি এবং সম্ভব হলে দুধ পান করতে হবে, ঙ. প্রয়ােজনে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।

৫। অনিদ্রা: গর্ভাবস্থায় শেষের দুই – তিন মাস অন্দ্রিার ভাব হয়। এ সমস্যা সমাধানে করণীয় দিক- ক. বিকেলে হাঁটা,শােবার আগে গরম দুধ খাওয়া বা বই পড়া ইত্যাদিতে উপকার হতে পারে, খ. প্রয়ােজন হলে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।

৬। খিল ধরা- গর্ভকালে কোন কোন স্নায়ুর উপর চাপ পড়লে গৰ্ভৰ্বতীর পা বা উরুতে খিল ধরতে পারে। গর্ভাবস্থায় ক্যালসিয়ামের অভাব হলেও এ রকম হতে পারে। এ সমস্যা সমাধানে করণীয় দিক- ক. পা শরীর থেকে উঁচু জায়গায় রেখে শুলে অথবা পা ছড়িয়ে বসে পায়ে তেল মালিশ করলে বা বার বার গােটালে ও ছড়ালে এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব।

৭। পিঠে ব্যথা- গর্ভের প্রথমাবস্থা থেকে এ কষ্ট অনেক সময় দেখা দেয় যা শেষের দিকে খুব বেড়ে যেতে পারে। এ সমস্যা সমাধানে করণীয় দিক- ক. শক্ত বিছানায় ঘুমালে উপকার পাওয়া যেতে পারে, খ. শিরদাঁড়ায় ম্যাসেজ করা যায়, গ. হাঁটা চলার সময় কোমরে বেল্ট ব্যবহারে উপকার পাওয়া যায়, ঘ. সামনে ঝুঁকে কোন কাজ করা যাবে না, ঘ. ভারী জিনিস উঠানাে যাবে না।

৮। পায়ের শিরা ফুলে যাওয়া অনেক সময় গর্ভবতী মায়ের শিরা ফুলে যেতে পারে। এ সমস্যা সমাধানে করণীয় দিক- ক. দীর্ঘ সময় দাঁড়ানাে যাবে না, খ. পা তুলে বসতে হবে, গ.প্রয়ােজনে ক্রেপ ব্যান্ডেজ বাঁধতে হবে, ঘ. প্রয়ােজনে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।

৯। পা ফোলা- গর্ভাবস্থায় পা ফুলতে পারে। শরীরে লবণ বৃদ্ধির ফলে পায়ের গােড়ালি ফুলে যায় ও পানি জমে। শরীরে পানি জমলে বা শরীর ফুলে গেলে, ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী রােগীর রক্ত চাপ, প্রস্রাব পরীক্ষা করা ও ওজন দেখা উচিত। এ সমস্যা সমাধানে করণীয় দিক- ক. পা উঁচুতে রেখে বিশ্রাম নেওয়া, খ. খাবারের সাথে বাড়তি লবণ না খাওয়া, গ. প্রয়ােজনে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।

১০। বুক ধড়ফড় ও শ্বাস কষ্ট- গর্ভাবস্থায় হার্টের কাজ বেড়ে যায়। কারণ মা ও শিশু উভয়ের শরীরে রক্ত সঞ্চালনের প্রয়ােজন হয়। এতে মায়ের রক্ত শূন্যতা দেখা দেয়। এসব কারণে বুক ধড়ফড় করে। জরায়ুর বৃদ্ধির ফলে ফুসফুসের ওপর চাপ পড়ে এবং স্বাভাবিক কাজকর্ম ব্যাহত হয়। ফলে শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। এ সমস্যা সমাধানে করণীয় দিক- ক. বিশ্রাম নিতে হবে, খ. একটানা হাটা ও কাজ করা যাবে না, গ. বেশি পরিমাণে পানি পান করতে হবে।

১১। মূত্র নালির সংক্রমণ- গর্ভাবস্থায় প্রস্রাবে জ্বালা পােড়া হতে পারে। এ সমস্যা সমাধানে করণীয় দিক- ক. প্রচুর তরল পানীয় খেতে হবে, খ. প্রয়ােজনে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।

১২। জ্বর- গর্ভাবস্থায় খুব জ্বর হলে মা ও বাচ্চার উভয়ের জন্য খুব বিপজ্জনক হতে পারে। এরূপ হলে হাসপাতালে বা ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত।

১৩। অর্শ- কোষ্ঠকাঠিন্য ও অর্শ যদি একই সঙ্গে থাকে তবে তা গর্ভাবস্থায় বেড়ে যায়। সুতরাং পায়খানা পরিস্কার হওয়া দরকার। এ অবস্থায় দেরী না করে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।

১৪। মাথা ব্যথা- অতিরিক্ত পরিশ্রম, ক্ষুধা এবং গরম লাগলে মাথা ব্যথা হতে পারে। এ কারণে এগুলাে এড়িয়ে চলা উচিত।

১৫। তলপেটে ব্যথা- জরায়ু ধীরে ধীরে বড় হয়ে এর আশে পাশের লিগামেন্টে টান পড়ার জন্য তলপেটে ও কুঁচকিতে হালকা ব্যথা হতে পারে। এ ব্যথা স্বাভাবিক। এ ব্যথা পাঁচ- ছয় মাসের দিকে হয়।

১৬। সাদা স্রাব- গর্ভাবস্থায় হরমােন ইস্ট্রোজেন ও রক্ত সরবরাহ বেড়ে যাওয়ার জন্য সাদা স্রাব বেড়ে যেতে পারে। ঢিলেঢালা পােশাক ও পরিস্কার পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে, সাদা স্রাবের সাথে যদি দুর্গন্ধ থাকে বা চুলকানি হয় তবে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।

১৭। বারবার প্রস্রাবের বেগ- গর্ভের প্রথম তিন থেকে চার মাস এটি হওয়া স্বাভাবিক। প্রস্রাবের জ্বালা পােড়া না থাকলে এ নিয়ে চিন্তার কোন কারণ নেই।

১৮। রক্তপাত- গর্ভকালীন সময়ে যে কোন ধরনের রক্তপাতই হতে পারে মায়ের স্বাস্থ্যের জন্য বিপদজনক। এক্ষেত্রে মাকে সাথে সাথে চিকিৎসকের কাছে নিতে হবে। জরায়ু ছাড়া অন্য কোন স্থানে ডিম্বাণুর অবস্থান (Ectopic pregnancy) ছােট খাটো অভ্যন্তরীণ ঝামেলাসহ গর্ভপাত হতে পারে এ সামান্য একটি কারণে। এছাড়াও আরাে কিছু সমস্যা বিশেষ করে প্রথমদিকে মাথা ঘােরা, অরুচি, দুর্বল লাগা, আলসেমি লাগা, শেষের দিকে উঠতে বসতে বা শােয়া থেকে উঠতে কষ্ট লাগা। গায়ে মুখে বিশেষ করে গলায় কালাে দাগ পড়া, পেটের চামড়া ফেটে যাওয়া বেশি পিপাসা লাগা বা ক্ষিধে পাওয়া এগুলাে হতে পারে।

গর্ভকালীন বিভিন্ন জটিল সমস্যা-

গর্ভপাত

যদি কোন কারণে গর্ভস্থ ভ্রণ আটাশ সপ্তাহ বা সাত মাসের পূর্বে মাতৃগর্ভের বা জরায়ু থেকে বের হয়ে যায় তবে তাকে গর্ভপাত বা এ্যাবরশন বলে। এ সমস্যা সমাধানে করণীয় দিক- ক. সন্তান সম্ভবা হলেই চিকিৎসকের কাছে পূর্বের সকল ইতিহাস খুলে বলতে হবে, খ. নিয়মিত চেকআপ জরুরী, গ. সন্তান সম্ভবা হওয়ার প্রথম দিকে রিকসা, বাস, ট্রাক, ট্রেন ইত্যাদির ঝাকুনি যথাসম্ভব এড়িয়ে চলা উচিত, ঘ. টিউবওয়েল পাম্প করা, পানি ভর্তি ভারী বালতি তােলা, বাচ্চা কোলে নেওয়া ঠিক নয়, ঙ. ছোঁয়াচে অসুখ থেকে গর্ভবতী মাকে দূরে রাখতে হবে, চ. দোকান বা হােটেলের খাবার না খাওয়াই ভালাে, ছ.প্রচুর পরিমাণে পানি পান করতে হবে।

প্রি-এক্লাম্পশিয়া

প্রি-এক্লাম্পশিয়া গর্ভধারণের বিশ সপ্তাহ অর্থাৎ পাঁচ মাস পর থেকে দেখা দেয়। এ সমস্যা সমাধানে করণীয় দিক- গর্ভবতী মায়েদের নিয়মিত চেক আপের ব্যবস্থা করা। গর্ভবতী মায়েদের পুষ্টিকর খাবার ও বিশ্রাম নিশ্চিত করা।

এক্লাম্পশিয়া বা গর্ভকালীন খিচুনী

এক্লাম্পশিয়া মূলতঃ প্রি-এক্লাম্পশিয়ার গুরুতর অবস্থা, গর্ভবতী মায়ের মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে এক্লাম্পশিয়া বা গর্ভকালীন খিচুনি । এ সমস্যা সমাধানে করণীয় দিক- প্রসব পূর্ব বা গর্ভকালীন পরিচর্যা নিয়মিত রক্ত চাপ মাপা, প্রস্রাবে প্রােটিন যায় কিনা পরীক্ষা করা, হাতে পায়ে পানি ইত্যাদি পরীক্ষা করা। যেহেতু এক্লাম্পশিয়া হওয়ার আগে প্রি-এক্লাম্পশিয়া হয়। তাই প্রি-এক্লাম্পশিয়া প্রতিরােধ করা গেলেই এক্লাম্পশিয়া হবে না।

প্রসবজনিত ফিস্টুলা

ফিস্টুলা হচ্ছে এক ধরনের অস্বাভাবিক নালি যার গায়ে কোষ কলা থাকে এবং যা আবরণী কলা দিয়ে আবৃত শরীরের যে কোন দুটি অংশের মধ্যে সংযােগ ঘটায়।

পেরিনিয়াম ছিড়ে যাওয়া

যােনি মুখে ও পায়ু পথের মাঝখানের জায়গাটিকে পেরিনিয়াম বলে। পেরিনিয়ামে কোন আঘাতের ফলে ক্ষত বা ছিড়ে যাওয়াকে পেরিনিয়াম ছিড়ে যাওয়া বলে।

Leave a Comment