মানব সংবেদী অঙ্গ
পারিপার্শ্বিক অবস্থার প্রকৃতি ও পরিবর্তন অনুধাবনে সক্ষম ইন্দ্রিয় সমূহকে সংবেদী অঙ্গ বা রিসেপ্টর বলা হয়। বিশেষ ধরনের সংবেদী কোষের সমন্বয়ে সংবেদী অঙ্গ গঠিত। মানব দেহের সংবেদী অঙ্গ হলাে চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা ও ত্বক।
এরা সাধারণভাবে পঞ্চ ইন্দ্রিয় নামে পরিচিত। এদের মধ্যে চক্ষু দর্শন অনুভূতি, কর্ণ শ্রবণ অনুভূতি ও ভারসাম্য অনুভূতি, নাসিকা ঘ্রাণ অনুভূতি, জিহ্বা স্বাদ অনুভূতি এবং ত্বক স্পর্শ অনুভূতি মস্তিষ্কে প্রেরণ করে।
চোখ (The eye)
করােটির সম্মুখে দুটি চক্ষু কোটরে এক জোড়া চোখ অবস্থিত। অস্থিময় চক্ষুকোটরে (orbit) পশ্চাৎ অংশে চর্বির প্যাড থাকায় চক্ষু সুরক্ষিত থাকে।
চোখের গঠন ও কাজ
চক্ষু গােলক গােলাকার বল আকৃতির অঙ্গ। এর ব্যাস ২৪ মিলিমিটার এবং ওজন ৬-৮ গ্রাম। এর বেশির ভাগ প্রায় ৫/৬ ভাগ অংশ চক্ষু কোটরে অবস্থান করে।
চক্ষু গােলক প্রধানতঃ তিনটি স্তর এবং কিছু আনুষঙ্গিক অঙ্গ নিয়ে গঠিত। যথা-
১। চোখের স্তর
ক. স্কেলেরা (Sclera)
স্ক্লেরা চক্ষু গােলকের সবচেয়ে বাইরের স্তর। এ স্তরটি সাদা, শক্ত এবং প্রধানত তন্তুময় যােজক কলা দ্বারা তৈরি। চক্ষু পেশি স্ক্লেরার সাথে সংযুক্ত থাকে।
কাজ: স্ক্লেরা চোখের আকৃতি রক্ষা করে, চোখকে সংরক্ষণ করে এবং পেশি সংযুক্ত রাখে।
কর্নিয়া (Cornea)
স্ক্লেরা আবরণীর সম্মুখ ভাগের স্বচ্ছ অংশের নাম কর্নিয়া।
কাজ : কর্নিয়ার মাধ্যমে চোখের ভেতরে আলাে প্রবেশ করে।
কনজাংটিভা (Conjunctiva)
কনজাংটিভা নামক একটি পাতলা স্বচ্ছ পর্দা দ্বারা কর্নিয়া আবৃত থাকে।
কাজ : কনজাংটিভা চোখে ব্যাকটেরিয়ার প্রবেশ রােধ করে এবং কর্নিয়াকে রক্ষা করে।
কোরয়েড (Choroid)
স্ক্লেরার নিচেই করয়েড স্তরের অবস্থান। এটি রক্তজালক সমৃদ্ধ। মেলানিন রঞ্জক পদার্থের কারণে এ স্তরটি ঘন কালাে।
কাজ: কালাে রঞ্জক পদার্থ চোখের ভেতরে আলাের প্রতিফলনকে বাঁধা দেয়। রক্তজালক চক্ষুর কোষে পুষ্টি যােগায়, অক্সিজেন সরবরাহ করে এবং বর্জ্য অপসারণ করে।
সিলিয়ারী বডি (Ciliary body)
চোখের সম্মুখ প্রান্তের কোরয়েড স্তর পুরু হয়ে সিলিয়ারী বডি গঠন করে।
কাজ: সিলিয়ারী বডিতে সিলিয়ারী পেশি থাকে যা লেন্সের বক্রতা অথবা পুরুত্ব নিয়ন্ত্রণ করে।
আইরিশ (Iris)
কর্নিয়ার পিছনের কোরয়েডের বাড়ানাে অস্বচ্ছ, মধ্য ছিদ্র যুক্ত ঘন কালাে গােলকের পর্দাকে আইরিশ বলে। এটি কোরয়েড স্তরের পরিবর্তিত অবস্থা। এটি কর্নিয়ার পিছনে ও লেন্সের সামনে অবস্থিত এবং এতে বৃত্তাকার ও রেডিয়াল পেশি থাকে। অটোনমিক স্নায়ুতন্ত্র দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। আইরিশের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলাে, যে কোন দুই জন মানুষের আইরিশ টিস্যু প্যাটার্ন এক রকম হয় না, এমনকি একই মানুষের বাম ও ডান আইরিশ ভিন্ন ভিন্ন প্যাটার্নের হয়। জন্মগতভাবে প্রাপ্ত এই আইরিশ প্যাটার্ন সারাজীবন অপরিবর্তিত থাকে।
কাজ: চোখে আলাের প্রবেশ বৃত্তাকার ও রেডিয়াল পেশি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। তাছাড়া বর্তমানে ব্যক্তি শনাক্তকরণের জন্য আইরিশ প্যাটার্ন ব্যবহার হচ্ছে।
পিউপিল (Pupil)
আইরিশের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত গােল ছিদ্রকে পিউপিল বলে ।
কাজ: পিউপিলের মাধ্যমে আলােকরশ্মি রেটিনার দিকে গমন করে।
সাসপেনসরি লিগামেন্ট (Suspensory ligament)
যােজক কলা যা লেন্সের প্রান্তকে সিলিয়ারী বডির সাথে যুক্ত করে।
কাজ: সাসপেনসরি লিগামেন্ট দ্বারা লেন্সটি যথাস্থানে অবস্থান করে।
গ. রেটিনা (Retina)
চক্ষু গােলকের সবচেয়ে ভেতরের স্তর রেটিনা। এ স্তরটি আলােক সংবেদী। এতে আলােক সংবেদী কোষ (Photoreceptor) থাকে। আলােক সংবেদী কোষগুলাে রড ও কোণ কোষ নিয়ে গঠিত। চোখে রড কোষের সংখ্যা প্রায় সত্তর লক্ষ। কোণ কোষগুলাে উজ্জ্বল আলােতে রঙিন বস্তু দর্শনের জন্য উপযােগী। রড কোষগুলাে অনুজ্জ্বল আলােতে দর্শনের উপযােগী।
কাজ: রেটিনাতে বস্তুর প্রতিবিম্ব তৈরি হয় ।
অন্ধবিন্দু (Blind spot)
অ্যাক্সনগুলাে অক্ষিগােলকের যে বিন্দুতে মিলিত হয়ে অপটিক স্নায়ু গঠন করে তাকে অন্ধবিন্দু বলে। কারণ ঐ স্থানে রড কোষ বা কোণ কোষ থাকে না।
ফোবিয়া সেন্ট্রালিস (Fovea centralis)
অন্ধবিন্দুর কাছাকাছি রেটিনার একটি অংশে প্রচুর কোণ কোষ দেখা যায়, রড কোষ থাকে না। এ অংশকে হলুদ বিন্দু,পিত বিন্দু, yellow spot বা ফোবিয়া সেন্ট্রালিস বলে।
কাজ: এখানে সবচেয়ে ভাল প্রতিবিম্ব তৈরি হয়।
অপটিক স্নায়ু
গ্যাংগ্লিওনিক নিউরনের অ্যাক্সনগুলাে একত্রিত হয়ে অপটিক স্নায়ু তৈরি করে।
কাজ: রেটিনায় সৃষ্ট প্রতিবিম্ব অপটিক স্নায়ুর মাধ্যমে মস্তিষ্কে পৌঁছে।
২। লেন্স
পিউপিলের পিছনে অবস্থিত ও সিলিয়ারী বডির সাথে সাসপেনসরি লিগামেন্টযুক্ত হয়ে ঝুলে থাকা একটি স্বচ্ছ স্থিতিস্থাপক ও দ্বিউত্তল চাকতির মতাে অংশকে লেন্স বলে।
লেন্স (Lens) এর কাজ : লেন্সের মাধ্যমে বস্তু থেকে আগত আলােক রশ্মি রেটিনার নির্দিষ্ট অংশে প্রতিফলিত হয়।
৩। চক্ষু গােলকের গহ্বর বা প্রকোষ্ঠ (Cavities of the eye ball)
চক্ষু গােলকে তরল পদার্থ পূর্ণ তিনটি গহবর থাকে।যথা-
(ক) অগ্র প্রকোষ্ঠ- এটি কর্নিয়া ও লেন্সের মধ্যবর্তী প্রকোষ্ঠ। এটি অ্যাকুয়াস হিউমার নামক পানির ন্যায় তরল পদার্থ দিয়ে পূর্ণ থাকে।
(খ) পশ্চাৎ প্রকোষ্ঠ- আইরিশ ও লেন্সের মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত প্রকোষ্ঠ যা অ্যাকুয়াস হিউমার দিয়ে পূর্ণ।
(গ) ভিট্রিয়াস প্রকোষ্ঠ- লেন্স ও রেটিনার মধ্যবর্তী বৃহৎ প্রকোষ্ঠ যা ভিট্রিয়াস হিউমার নামক জেলির ন্যায় তরল পদার্থ দ্বারা
পূর্ণ থাকে।
চক্ষু গােলকের গহ্বর এর কাজ :
ক. অ্যাকুয়াস হিউমার আলাের প্রতিসরণে সাহায্য করে, চোখের সম্মুখ অংশের আকৃতি ঠিক রাখে এবং লেন্স ও কর্নিয়ায় পুষ্টি সরবরাহ করে ।
খ. ভিট্রিয়াস হিউমার রেটিনার দিকে আলাের প্রতিসরণে সাহায্য করে ও চক্ষু গােলকের গােলাকার আকৃতি বজায় রাখে।
চোখের আনুষঙ্গিক অঙ্গ (Accessory organs)
ক. চক্ষু পল্লব বা চোখের পাতা (Eyelid)
চোখের পাতা দুটি। এরা চোখের বহির্ভাগের আবরণ।
কাজ: চোখকে ধূলাবালি থেকে রক্ষা করে, যান্ত্রিক বা রাসায়নিক ক্ষতি থেকে কর্নিয়াকে রক্ষা করে এবং প্রতিবর্তী ক্রিয়ার মাধ্যমে উজ্জ্বল আলাে থেকে রেটিনাকে রক্ষা করে।
খ. অক্ষিপক্ষ (Eyelash): চোখের পাতার লােমকে অক্ষিপক্ষ বলে।
কাজ: উড়ন্ত কীটপতঙ্গ ও ধূলা বালিকে চোখে প্রবেশে বাধা দেয়।
গ. চক্ষু ভ্রু(Eye brow): চোখের পাতার উপরের অংশের লােমকে চক্ষু ভ্রু বলে।
কাজ: কপাল থেকে গরিয়ে আসা ঘাম চোখে প্রবেশে প্রতিহত করে।
ঘ. অশ্রু গ্রন্থি: উপরের চক্ষু পল্লবের কোনায় অশ্রু গ্রন্থি থাকে যা থেকে অশ্রু (tear) তৈরি হয়। সােডিয়াম ক্লোরাইড,সােডিয়াম বাইকার্বনেট ও পানি সমন্বয়ে অশ্রু তৈরি হয়। অশ্রুতে লাইসােজাইম নামক একটি এনজাইমও থাকে। অশ্রু গ্রন্থিকে ল্যাক্রিমাল গ্রন্থি (lacrimal gland)ও বলে।
কাজ: অশ্রু চোখকে সিক্ত রাখে, ধূলা ও ময়লা পরিস্কার করে এবং ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস করে।
ঙ। চক্ষু পেশি (Eye muscle):
চক্ষু গােলক দুইজোড়া রেকটাস পেশি ও একজোড়া অবলিক পেশির সাথে সংযুক্ত
থাকে।
কাজ : অক্ষি কোটরের অভ্যন্তরে চক্ষুকে স্বস্থানে ধরে রাখতে এবং চক্ষুর সঞ্চালনে সাহায্য করে।
চ। অক্ষি কোটর: এ অংশটি একটি ফাঁপা গর্তবিশেষ।
কাজ : এতে চক্ষু গােলক সুরক্ষিত থাকে।